নিজস্ব প্রতিবেদক:
ক্রাচে ভর দিয়ে জীবন যুদ্ধে পথচলা শাপলার। হাটুর উপর থেকে একটা পা নেই। কিন্তু হার মানাও নেই। জীবন যে বড় সুন্দর। বাবা মা আর ভাইয়ের আদরে এগিয়ে চলা। প্রতিবন্ধতার সীমানা পেরিয়ে সফলতাকে স্পর্শ করা।
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মাঝগাঁও মাথাইমুড়ি গ্রামের বাসিন্দা শাপলার কৃষিজীবী বাবা সাবদুল ইসলাম জানান, প্রাথমিকে সবে পড়ালেখা শুরু করেছে ও। হাটু ব্যথাতে পড়ে যেয়ে আঘাত পেল। ডাক্তার জানালেন, হাটুতে টিউমার। পা কেটে ফেলতে হবে। তা না হলে রুপান্তর হবে ক্যান্সারে। সকলের আদরের শাপলা’র কচি শরীর থেকে ডান পা বিছিন্ন করা হলো। ওর পা’য়ে রক্তের স্রোত। আর আমাদের হৃদয় জুড়ে রক্তের স্রোত, চোখে কান্নার স্রোত। সেই ২০১০ থেকে একটা পা আর ক্রাচে ভর করে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছে আমার মা।
শাপলা বনপাড়ার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা অনার্স কলেজ থেকে রাস্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছে। গতকাল নাটোর জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিস থেকে তাঁর হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। শাপলা এখন পরিবার কল্যাণ সহকারী। ‘এ তো নিয়োগপত্র নয়, যেন সোনার হরিণ’-শাপলার ভাষ্য। শাপলা বলে,‘বাড়ির বাইরে স্কুল-কলেজে যেতে আব্বুই আমার অবলম্বন। আর এখন আমার অবলম্বন হচ্ছে, পরম কাংখিত চাকুরী। বেঁচে থাকার অবলম্বন। জীবনের প্রথম আবেদনেই সাফল্য। এই সাফল্যে শুধু স্বস্তি আমার নয়, তারচে’ বেশী আব্বু-আম্মু আর ভাইয়া’র। মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে চাই আমি।
একই উপজেলার জোয়াড়ী আহম্মদপুরে খাস জমিতে ছোট্ট একটা খুপরী বাড়িতে বাস করেন নরসুন্দর সুনীল বিশ্বাস। এর একটা ঘরে স্ত্রীসহ সুনীল বিশ্বাস। আর অন্য একটা ঘরে রিমা, রুমা আর বাপ্পী-এই তিন ভাই-বোনের গাদাগাদি অবস্থান। অনিশ্চিত উপার্জন হলেও সুনীল বিশ্বাস তিন ছেলে-মেয়েকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ফেলতে চাননি। নিজে পড়াশুনা না জানলেও ছেলে-মেয়েদের পাঠিয়েছেন স্কুল কলেজে। সবার ছোট রুমা এসএসসি পরীক্ষার্থী, বাপ্পী এইচএসসিতে। সবার বড় রীমা রসায়নের প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষা শেষ করেছে। মেধাবী রীমার ঝুলিতে আছে জিপিএ ফাইভ। নাটোরের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজে পড়তে পড়তে আবেদন করে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে। সব মিলিয়ে খরচ একশ’ টাকা। ‘মাত্র একশ’ টাকা খরচে পরিবার কল্যাণ সহকারী পদে চাকুরী পেয়ে বাকরুদ্ধ রীমা বিশ্বাস।
নিয়োগপত্র পাওয়ার দিনে বাড়িতে বসে সুনীল বিশ্বাসের সাথে কথা হয়। মধ্য বয়সী সুনীলের চোখে পানি। তিনি সুখের কান্নায় ভাসলেন। বললেন, আমার মেয়ে নাটোরে গেছে, ওর চাকরী হইছে। এ তো স্বপ্নের মত! আমার তো লোকজন কেউ নেই, টাকাও নেই। তাই কখনো ভাবিনি সরকারি চাকরী হবে। যারা বিনে পয়সায় এই চাকরী দিলো ঈম্বর যেন তাদেরকে সুখে রাখেন।
পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ নাটোর জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক মাহফুজা খানম জানান, ৩১ আগস্ট ২০২১ জেলা কার্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। প্রায় তিন হাজার আবেদনকারীর লিখিত পরীক্ষা শেষে গত ১৩ থেকে ১৯ নভেম্বর মৌখিক পরীক্ষা হয়। পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক পদে সাতজন, পরিবার কল্যাণ সহকারী পদে ৬৩ জন এবং আয়া পদে চারজন নিয়োগ পেয়েছেন গতকাল। মেধা এবং কোটাকে যথাযথভাবে অনুসরণ করে স্বচ্ছতা ও সততার সাথে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সক্ষম হওয়া অনেক প্রশান্তির।
নিয়োগ কমিটির প্রধান নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, জনমুখী সরকারি সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। মেধা এবং প্রয়োজনে কোটাকে বিবেচনা করে সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কাজের প্রতি দায়িত্বশীল এবং মানুষের প্রতি মমত্বশীল হবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই জেলা প্রশাসনের অধীন সকল নিয়োগ প্রক্রিয়া শতভাগ স্বচ্ছতা আর সততার সাথে সম্পন্ন করা হয়।