ডেস্ক নিউজ
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে দক্ষিণ এশিয়ায় ওপরের সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই ঘটছে চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে। এবার আধুনিক ইন্টেলিজেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গাড়ির বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। স্পিড মনিটরিং ক্যামেরা ও ভেহিক্যাল ডিটেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে রিয়েল টাইম মনিটরিংয়ে থাকবে যানবাহন ও চালক। ফলে গাড়ির নিয়ন্ত্রিত গতিতে কমবে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু।
নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও টেকসই সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে মহাসড়কে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম নামের নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। গত একনেক সভায় ১২২ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। যার মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৩৮ কোটি টাকা আর দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের অর্থায়ন রয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ৪০ কিলোমিটার এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে কাজটি শেষ করবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।
দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রতিনিয়ত বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেপরোয়া গতির চালক আর ওভারটেক করার মানসিকতা। তবে এসব নিয়ন্ত্রণে ঠিকমতো নজরদারির করার সক্ষমতার ঘাটতি থাকায় পার পেয়ে যেতেন চালকেরা। এবার এ প্রকল্পটির মাধ্যমে সড়কে একক নজরদারি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। যার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যানবাহনের সংখ্যা, গতি ও দুর্ঘটনার তথ্য ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে পাঠানো যাবে। এর জন্য একটি অত্যাধুনিক ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টার তৈরি করা হবে। এতে কম সময়ে জ্বালানি সাশ্রয়ীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি বলেন, আমরা নিয়ম-কানুন মানি না। নির্দিষ্ট গতিসীমা মানতে চাই না। এটা জাতিগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এ প্রকল্পটির মাধ্যমে বেশি গতিতে গাড়ি চালালে সঙ্গে সঙ্গে তথ্য পাওয়া যাবে। এমনকি আমরা চালকের ছবিও দেখতে পাব।
প্রকল্পের ৪০ কিলোমিটার রাস্তায় ৬৭টি পুল স্থাপন করা হবে। যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে ২৪টি, ভিজ্যুয়াল ডিসপ্লে থাকবে ৮টি এবং অন্য যন্ত্র থাকবে ৭টি। সব যন্ত্রপাতি কোরিয়ান সংস্থার সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে। আর ঢাকার সেন্টার থেকে সবকিছু মনিটরিং হবে ।
প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে আধুনিক এ প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা। তাছাড়া সিসি ক্যামেরা, স্পিড ক্যামেরা, ভেরিয়েবল মেসেজ সাইন, গাড়ি শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন ও সংশ্লিষ্ট জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ৮৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
৫০ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনে ব্যয় হবে পৌনে ৩ কোটি টাকা। ভৌত কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি টাকার বেশি। ট্রাফিক সেন্টার স্থাপনে ব্যয় হবে প্রায় ৩ কোটি টাকা। বিভিন্ন ভ্যাটে ১২ কোটি আর পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির বিষয়ে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকল্প পরিচালক মো. তানভীর সিদ্দিক বলেন, পাইলট প্রকল্প হিসেবে নির্দিষ্ট একটি করিডরে কিছু ক্যামেরা স্থাপন করা হবে। যার মাধ্যমে একটি মনিটরিং সেন্টার থেকে রাস্তার গাড়ির গতি, জ্যাম, দুর্ঘটনা বা যে কোনো ঘটনা নজরদারির আওতায় আনা হবে। তাৎক্ষণিক এই মনিটরিংকে ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম বলা হচ্ছে।
এই সিস্টেমের মাধ্যমে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে পিডি বলেন, কেউ যদি নির্দিষ্ট গতিসীমা লঙ্ঘন করে তাহলে একটি ডকুমেন্ট থাকবে এই ট্রাফিক সিস্টেমে। পরবর্তীতে এই ডকুমেন্টটি হাইওয়ে পুলিশের মাধ্যমে জরিমানা আকারে নির্দিষ্ট চালকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জানান, যদি রাস্তায় কোনো জ্যাম হয় বা দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে রাস্তায় থাকা মেইনটেনেন্স ইউনিটকে জানানো হবে। তারা দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি সরাবে বা জ্যাম নিরসনে কাজ করবে।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহনের সংখ্যা ও গতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সড়কটিতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে দুর্ঘটনাও। তাই গতি নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির জন্য এ সড়কটিকে প্রকল্প এলাকা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে।
এর আগে দেশে প্রথবারের মতো এ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয় জয়দেবপুর-রংপুর সড়কে। সেখানে ২৬০ কিলোমিটার সড়কে ১৫টি মনিটরিং টাওয়ার বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। গত এপ্রিল মাসে ১৯০ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল।
তাছাড়া ঢাকার চারটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এ প্রযুক্তি স্থাপনের একটি প্রকল্প এখনো শেষ হয়নি। ৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে গুলশান-১, মহাখালী, পল্টন ও ফুলবাড়িয়া মোড়ে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের কাজের সময় প্রকল্পের সার্ভার সংযোগের তার কেটে যাওয়ায় তা আবার প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক সিস্টেম নামের প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
এদিকে বাংলাদেশে আগামী ১০ বছরে বিভিন্ন সড়কে পর্যায়ক্রমে এ প্রযুক্তি ব্যবহারে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার বেশি লাগতে পারে বলে ধারণা দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারি সংস্থা কইকা। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে এ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণা দেয় সংস্থাটি। সেখানে তিনটি পর্যায়ে দেশের সড়কে এ ব্যবস্থা গড়ে তোলার একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।
বিভিন্ন সংস্থা আলাদাভাবে বিভিন্ন সড়কে এ প্রযুক্তির বিষয়ে প্রকল্প নিচ্ছে। এ বিষয়ে প্রকৌশলী মো. তানভীর সিদ্দিক বলেন, সব সড়ককে এক ছাতার নিচে আনার জন্য একটি ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে। অন্য কোনো কোনো রাস্তায় আংশিকভাবে এটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হলেও এ প্রকল্পের মাধ্যমেই একটি পূর্ণাঙ্গ সিস্টেম তৈরি করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
প্রকল্পটি নিয়ে গত এপ্রিল মাসে পরিকল্পনা কমিশনের মূল্যায়ন কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পরামর্শক ব্যয় ১০ কোটি টাকার মধ্যে সীমিত রাখার কথা বলা হয়। একই ধরনের প্রকল্পের দ্বৈততা পরিহারে সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি ম্যাপিং করতে বলা হয়। অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনে বিটিআরসির অনুমোদন নিতে বলা হয়।
তাছাড়া কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে কিভাবে দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তি ও যানবাহনকে উদ্ধার করা হবে বা কোথায় স্থানান্তর করা হবে তা বিস্তারিত জানতে চেয়েছে কমিশন। পরবর্তীতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে একটি দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে বলে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় ১০ কোটি টাকা একটু বেশি কিনা প্রশ্ন ছিল প্রকল্প পরিচালকের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, তিন বছরের জন্য যে পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়েছে এটা দিয়ে মূলত ট্রাফিক সেন্টার অপারেট করার জন্য লোকবল নিয়োগ দেওয়া হবে। ৩৬ মাসে ৩ শিফটে ৪ জন করে দিনে ১২ জন বাইরে থেকে আউটসোর্সিং হিসেবে নেওয়া হবে। আর মূল পরামর্শক হিসেবে কোরিয়ান কোম্পানি কাজ করবে।
প্রকল্পটির বিষয়ে সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে এমন একটি প্রকল্প নেওয়া হলেও পরে মনিটরিং করার লোকবল না থাকায় তা সফল হয়নি। তাই প্রকল্পটির সফলতার জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে দক্ষ লোকবল দরকার মনে করেন তিনি।