- দুর্গম চর কিংবা পাহাড়ী বসতিতেও পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো
- শিক্ষার বিস্তার ঘটছে কৃষির সম্প্রসারণ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে সম্পৃক্ত হচ্ছে মানুষ ব্যাপক কর্মসংস্থানের সঙ্গে সঙ্গে আয় বাড়ছে গ্রামের মানুষের ষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার পথে হাঁটছে দেশ
রশিদ মামুন ॥ দেশের ৯৮ ভাগ মানুষ এখন বিদ্যুত সুবিধা ভোগ করছে। দুর্গম চর কিংবা পাহাড়ী জনপদে পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। এতে শিক্ষার বিস্তার ঘটছে। ঘটছে কৃষির সম্প্রসারণ। ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে মানুষ। যাতে করে গ্রামীণ জনপদে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যুত সম্প্রসারণে নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটছে। যা আশা জাগানো ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যমুক্ত নতুন স্বপ্নের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলছে।
বিদ্যুত কিভাবে মানুষের জীবনধারা বদলে দিচ্ছে তা অনুসন্ধানে নেমে গত দু’বছরে দুটি বিচ্ছিন্ন এলাকায় বিদ্যুত সেবা সম্প্রসারণের খোঁজ নেয়া হয়েছে। বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেখানে নীরব এক অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব দ্রুতই এই পরিবর্তন চোখে পড়ছে। তবে এর দীর্ঘমেয়াদী একটি প্রভাব রয়েছে। সেই প্রভাবই বাংলাদেশকে আমূল বদলে দেবে।
শরীয়তপুরের নড়িয়ার নওপাড়া ইউনিয়নে প্রমত্তা পদ্মার বুকে অর্ধশতাব্দী আগে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছিল। গত ফেব্রুয়ারির শেষদিকে এখানে সাবমেরিন ক্যাবলে বিদ্যুত সরবরাহ শুরু করা হয়েছে। গত সাত মাস এখানে বিদ্যুত সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যেই দুর্গম এই চরের মানুষের জীবনে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ আজগরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম- কী পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন তিনি।
রাশেদ আজগরের ভাষায়- আগে যখন বিদ্যুত ছিল না তখন সাতটা বড়জোর আটটার মধ্যেই এই চরে সব ঘরের কেরোসিনের বাতি নিভে যেত। এখন ১১ থেকে ১২টা অবধি ঘরে ঘরে আলো জ¦লে, মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে হাটঘাটমাঠ। মানুষ ঘরে ঘরে টেলিভিশন কিনেছেন। কেউ কেউ ফ্রিজও কিনেছেন। তিনি বলেন, বিদ্যুতের আলোর সব চাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে, মানুষের কর্মঘণ্টা বেড়েছে। গ্রামে যে মানুষটি আগে ব্যয়বহুল ডিজেলে সেচ দিতেন এখন সেখানে বিদ্যুত ব্যবহার হচ্ছে। মানুষ চাইলেই ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপন করতে পারছেন। তিনি মনে করেন, গ্রামীণ জীবনে শিক্ষার একটি বড় মাধ্যম টেলিভিশন। বিদ্যুত আসায় ঘরে ঘরে টেলিভিশন চলছে। এখান থেকে প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োজন নানা বিষয়ে মানুষ সচেতন হতে পারছেন। মানুষ যদি সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাহলেই তার জীবন বদলে যাবে। সেই কাজ সহজ করতে এখন আধুনিক প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে মানুষের সংযোগ ঘটছে। বিদ্যুত না থাকায় গত বছরও সেটি ধারণাই করতে পারতেন না এখানের মানুষ।
গত বছর জানুয়ারিতে সন্দ্বীপে একইভাবে সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। চট্টগ্রামের এই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বিদর্শী সম্বোধি চাকমা বলেন, এখানকার মানুষ এখন অনেক সৌখিন হয়ে গেছেন। ঘরে ঘরে মানুষ এখন টেলিভিশন, ফ্রিজ এবং এসি লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, বিদ্যুত আসায় এখানে নীরব এক অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটে গেছে। এখানে এসে সচক্ষে না দেখলে এই পরিবর্তন বলে বোঝানো যাবে না।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বলছে, সারাদেশে বিদ্যুত ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি অনেকটা সফলভাবেই করেছে তারা। এখন তাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ নিরবচ্ছিন্ন এবং মানসম্মত বিদ্যুতের সেবা পৌঁছে দেয়া। সরকার প্রত্যেকটি গ্রামে শহরের সেবা সম্প্রসারণ করতে চাইছেন। সেই কাজ করতে হলে সবার আগে সেই গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছে দিতে হবে। আরইবি বলছে, ইতোমধ্যে তারা ৮৪ হাজার ৮০০ গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সব গ্রামে বিদ্যুত সরবরাহের কাজ শেষ করতে চায় তারা। আরইবির এখন সন্ধ্যাকালীন সর্বোচ্চ চাহিদার সময় সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত প্রয়োজন হচ্ছে।
গ্রামীণ জনপদে কৃষি এবং শিল্পে ব্যাপকভাবে বিদ্যুত ব্যবহার হচ্ছে। আগে কৃষি সেচের জন্য ডিজেল নির্ভরতা থাকলেও এখন প্রায় প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছে যাওয়াতে উল্লেখযোগ্য হারে সেচ সংখ্যা বেড়েছে। হিসাব বলছে, ২০০৯ এ যেখানে সারাদেশে সেচ সংযোগ ছিল দুই লাখ ৩৪ হাজার সেখানে এখন সেচের গ্রাহক এক লাখ ২৮ হাজার বেড়ে তিন লাখ ৬২ হাজার। প্রবৃদ্ধি ৫৬ ভাগের উপরে। এর বাইরে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সরকারী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ইডকল ৫০ হাজার সৌর সেচ পাম্প স্থাপন করছে। এতে করে বিদ্যুতেই পানি উঠলেও গ্রিডের বিদ্যুতের খরচ কম হবে।
পরিসংখ্যান বলছে, সারাদেশে সেচ ছাড়াও ক্ষুদ্র এবং বাণিজ্যে গ্রামীণ জনপদে ১৯ লাখ ৫১ হাজার ১১৩টি সংযোগ রয়েছে। এরমধ্যে ক্ষুদ্র শিল্পে সংযোগ সংখ্যা এক লাখ ৭৮ হাজার ৯৩৪টি। অর্থাৎ গ্রামের মানুষ এখন আর শুধু চাকরির আশায় বসে থাকছেন না। তারা কোন না কোনভাবে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। সারাদেশে মৎস্য উৎপাদন, মুরগি পালন, গবাদিপশু পালনে গত কয়েক বছরে অভাবনীয় এক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। এখন বিদ্যুত থাকায় মৎস্য উৎপাদনে আধুনিক সব কারিগরি প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে অধিক ঘনত্বে মৎস্য উৎপাদন করা যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রত্যন্ত গ্রামে হাঁস, মুরগির ডিম থেকে ইনকিউবেটরে বাচ্চা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। এভাবে দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রতি দিনের সব ধরনের খাদ্যের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। এতে কর্মমুখর হয়ে উঠেছে গ্রামীণ পরিবেশ। সারাদেশে এখন তিন কোটি ৮৪ লাখ বিদ্যুত গ্রাহক রয়েছে। গত ১০ বছরে মাথা পিছু বিদ্যুতের উৎপাদন ২২০ কিলোওয়াট থেকে বেড়ে হয়েছে ৫১২ কিলোওয়াট। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯২ কিলোওয়াট।
জানতে চাইলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন অনজন কান্তি দাশ বলেন, সরকার প্রতিটি শহরে গ্রামের সেবা পৌঁছে দিতে চায়। এজন্য আমরা সব গ্রামে বিদ্যুতের সেবা পৌঁছে দিয়েছি। তিনি বলেন, আমি তো দেশের বিভিন্নস্থানে যাই। আমি এখন আর কোন মানুষকে বসে থাকতে দেখি না। তারা কিছু না কিছু করছে। ১০ থেকে ১৫ বছর আগে যেভাবে গ্রামে গেলে বেকার মানুষ দেখা যেত এখন আর তা দেখা যায় না। তিনি বলেন, আমরা গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছি। এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ করা। এজন্যই এখন বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে।
বিদ্যুত কিভাবে মানুষের জীবন বদলে দিচ্ছে সে বিষয়ে কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ তৈরি করেছে বিদ্যুত বিভাগ। এর একটিতে দেখানো হয়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গার মেয়ে রূপা। আজ আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন। লেখাপড়া করার পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন বাচ্চাদের পোশাক তৈরির কারখানা। সেখানে এই শিক্ষার্থী নিজের সঙ্গে অন্য নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এই তো ক’বছর আগেও যে নারী সন্ধ্যা হতেই কুপি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন; বিদ্যুতের আলো পেয়ে তিনি এখন উদ্যোক্তা। এই উপজেলার মানুষ এখন গ্রামে বসেই সাইবার ক্যাফেতে অনলাইনে ফ্লাইটের আপডেট যেমন নিচ্ছেন তেমনি নিজের টিকেট নিজেই কাটছেন। এখানের অনেক শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করছেন। শুধু এই ফদিরপুরের ভাঙ্গাই নয়, সারাদেশে উন্নয়নের এই ছোঁয়া লেগেছে। একটু সচেতন মানুষ এখন আর বসে সময় নষ্ট করেন না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শহরের মানুষ সকাল ছটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ইচ্ছা করলে কাজ করতে পারেন। অন্যদিকে গ্রামে বিদ্যুত না থাকলে মানুষ সাধারণ সন্ধ্যা আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু বিদ্যুত থাকলে তারাও রাত ১২টা পর্যন্ত জেগে থাকেন। ফলে তাদেরও শ্রমঘণ্টা বা কর্মপরিধি বেড়ে যায়। এখানে প্রতিদিন মানুষ আরও চার ঘণ্টা বেশি সময় পাচ্ছেন। এই সময়ে গ্রামের অনেক মানুষই চাইলে নিজের উপার্জন বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে পারেন। শুধু তাই নয়, যে শিশুটি সন্ধ্যা হতেই ঘুমিয়ে পড়ত এখন সেও রাত দশটা পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পায়। এতে করে স্কুলে ভাল করলে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ফলে ঝরে পড়ার হার কমে।
জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুতের এই সম্প্রসারণ অর্থনীতির ওপর কী প্রভাব ফেলছে তার মূল্যায়ন আমরা এখনও করে উঠতে পারিনি। তবে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ায় আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এখন গ্রামে গেলে আর বেকার মানুষ পাওয়া যায় না। যে মানুষটি আগে কিছুই করতেন না তিনি হয়ত একটি ব্যাটারি চালিত ভ্যান বা ইজিবাইক চালাচ্ছেন। মূল বিষয় হচ্ছে, মানুষ যদি কোন না কোনভাবে আয় করতে পারেন, তাহলেই তার জীবন বদলে যাবে। যার হাতে টাকা আছে তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন তার সন্তান স্কুলে যাক। লেখাপড়া শিখুক। এভাবেই আসলে পরিবর্তনটি আসছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছর পরে এর যে প্রভাব দেখা যাবে তা হয়ত কেউ কল্পনাই করতে পারছেন না।