ডেস্ক নিউজ
অবশেষে সম্পন্ন হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের ১২৩০ কোটি টাকার পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ। দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে সরকার গৃহীত বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। এই টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে বার্ষিক কন্টেনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টিইইউএস। পিপিপি (সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্ব) ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনায় আগ্রহ দেখিয়েছে বেশক’টি বিদেশী প্রতিষ্ঠান।
তবে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের পূর্বেই এটি চালু করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আগামী ২১ জুলাই ভিড়বে প্রথম জাহাজ। এর মধ্য দিয়ে ১৫ বছর পরে চট্টগ্রাম বন্দর পেতে যাচ্ছে নতুন একটি টার্মিনাল, যা বন্দরকে উন্নীত করছে নতুন উচ্চতায়।
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সিংহদ্বার, যার মধ্য দিয়ে ৯২ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়ে থাকে। শিল্পায়ন, অভ্যন্তরীণ ভোগ এবং রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিবছরই বাড়তি কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে হচ্ছে বন্দরকে। ভবিষ্যত চাহিদা বিবেচনায় বন্দর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় যে ক’টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তার মধ্যে একটি এই পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল। মোহনার একেবারে কাছাকাছি হওয়ায় এই টার্মিনালে ভিড়তে পারবে বিদ্যমান বন্দরের চেয়ে অধিক ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ।
বর্তমান বন্দরের জেটিগুলো বঙ্গোপসাগরের ১৪ কিলোমিটার উজানে। কিন্তু এই টার্মিনালটির সঙ্গে মোহনার দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। ফলে অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে জাহাজ আসা-যাওয়া করতে পারবে। এতে করে সময় কম লাগবে। ফলে জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম (অপেক্ষার সময়) কমবে। বিদ্যমান বন্দরে যেখানে ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে, সেখানে পতেঙ্গা টার্মিনালের জেটিগুলোতে ১০ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। আকারে বড় জাহাজ আসতে পারবে বিধায় অধিক পণ্য পরিবহন করা যাবে। এছাড়া এর অবস্থান মোহনায় হওয়ায় কর্ণফুলীর ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক অতিক্রম করতে হবে না। ফলে জাহাজ চলাচলও নির্বিঘ্ন হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, একাধিক দফায় সময় বাড়ানোর পর প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২২ ছিল সালের জুন মাস পর্যন্ত। ২০০৭ সালে নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) চালু হওয়ার প্রায় পনেরো বছর পর এটি আরেকটি টার্মিনাল যা অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। টার্মিনালটি চালু হলে বন্দরের কন্টেনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে আরও ৪ লাখ ৪৫ হাজার টিইইউএস। এছাড়া বাড়বে বন্দর অভ্যন্তরস্থ ইয়ার্ডের কন্টেনার ধারণক্ষমতাও। ওই স্থানে গভীরতা কিছু বেশি পাওয়া যাবে। টার্মিনালটিতে থাকছে মোট চারটি জেটি। এরমধ্যে ৩টি কন্টেনার জেটি এবং অপরটি তেল খালাসের জন্য ডলফিন জেটি। প্রকল্পটি অনুমোদিত হয় ২০১৭ সালে। আর বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে।
পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান সরকার জনকণ্ঠকে জানান, নবনির্মিত এই টার্মিনালে আগামী ২১ জুলাই প্রথম জাহাজ ভেড়ানো হবে। এই জাহাজটি হবে কার্গো (খোলা পণ্য) ভেসেল। পরে কন্টেনার জাহাজও ভিড়বে। তবে কী-গ্যান্ট্রি ক্রেন না থাকায় সেখানে আপাতত গিয়ারড (ক্রেনযুক্ত) জাহাজ ভেড়ানো হবে। অপারেটর নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত জাহাজগুলোতে সংযুক্ত নিজস্ব ক্রেন দিয়েই কন্টেনার হ্যান্ডলিং হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কন্টেনাল টার্মিনাল পরিচালনায় আগ্রহ দেখিয়েছে ৫টি বিদেশী প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসসিটি), দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ড, পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি (পিএসএ), ভারতের আদানি স্পেশাল ইকনোমিক জোন অথরিটি এবং ডেনমার্কভিত্তিক এপি মুলার। যে প্রতিষ্ঠানই কাজ পাক না কেন, তাকে যন্ত্রপাতি নিয়েই আসতে হবে। টার্মিনালটি পরিচালিত হবে সরকারী বেসরকারী অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে।
ব্যবসায়ীদের অন্যতম শীর্ষ সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, অনেক প্রতীক্ষার পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে তা চালু হতে যাচ্ছে, এটি অনেক খুশির খবর। কেননা, নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। নির্মাণের পরও ওই টার্মিনাল চালু হতে ৭ বছর সময় লেগেছিল। আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে তাতে করে বন্দরের উৎপাদনশীলতা না বাড়িয়ে কোন বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণ ও সক্ষমতা সময়ের দাবি।
বিদেশী অপারেটরের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন ॥ পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল বিদেশী অপারেটর দিয়ে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। বন্দর সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন, বন্দরের টার্মিনাল এমনই যে অপারেশন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক আয়ও শুরু। বিদেশী অপারেটর হলে এই টার্মিনাল থেকে আয় করা অর্থের সিংহভাগই বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে বেসরকারী অপারেটর দেশী হওয়াই মঙ্গল।
বন্দর ব্যবহারকারী একাধিক সূত্র বলছে, নিজস্ব অর্থায়নে ১২শ’ কোটি টাকা দিয়ে টার্মিনাল নির্মাণ করে তা পরিচালনার জন্য বিদেশী অপারেটর নিয়োগ করতে হবে কেন? আর ৫শ’ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি সংযোজন করার মতো সক্ষম প্রতিষ্ঠান এই দেশেই রয়েছে। বিদেশী অপারেটর হলে আয়ের ৮৫ ভাগই বিদেশে চলে যাবে। আর দেশীয় অপারেটর হলে সে অর্থ দেশেই থাকবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। বর্তমান বৈশি^ক পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা করার দিকটি সর্বোচ্চ বিবেচনায় থাকা উচিত বলে অভিমত তাদের।