পত্রিকার লেখায় ঘাবড়ে না গিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারি কর্মকর্তাদের পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় তিনি বলেন, ‘আমি যদি ভয়ে ভয়ে থাকতাম-ও কী লিখল, ও কী বলল, ও কী করল, তাহলে কোনো কাজ করতে পারতাম না। নিজের বিশ্বাস হারাতাম।’ খবর বাসস ও অনলাইনের। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সভায় যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় পত্রিকা পড়ে আপনারা ঘাবড়ান। এই পত্রিকা এই সমালোচনা করেছে। বাংলাদেশের কিছু পত্রিকা আছে তারা সবকিছুতে একদিন ভালো লিখলে পরের সাত দিন লিখবে খারাপ। এটা তাদের চরিত্র। আমি চিনি সবাইকে। পরিবারকেও চেনা আছে। কাজেই ওই পত্রিকা দেখে ঘাবড়ানোর কোনো দরকার নেই। আর পত্রিকা পড়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার নেই।’
কাজের ব্যস্ততার মাঝেও একদিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে টক শো দেখার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেউ কেউ দেখলাম ইদানীং একটা কথা খুব বেশি প্রচার করার চেষ্টা করছেন। তা হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। তারা টাকার অঙ্ক দিয়ে দেখাতে চাচ্ছেন যে, এত টাকা খরচ করার দরকারটা কী ছিল। আমি শুধু এটুকুই বলব, আমরা যখন সরকার গঠন করে রেন্টে পাওয়ার প্ল্যান্ট এনে কাজ শুরু করলাম, তখনো এরা বলছেন, এটার দরকারটা কী ছিল। এতে নাকি ভীষণ দুর্নীতি হচ্ছে। আর আজকে আমরা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, যেটা সব থেকে বেশি পরিবেশবান্ধব, কোনো পলিউশান নেই, আনাতে খরচ বেশি কিন্তু বিদ্যুৎসাশ্রয়ী। তাছাড়া আমরা তো একটি দেশের সঙ্গে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ নিয়েই এটা করেছি। সেখানে আমাদের টাকার অঙ্ক কম। আমরা টাকা পেয়েছি এবং সেটা আমাদের শোধ দিতে হবে ৫০ বছরে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এর থেকে যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একটা সুযোগ সৃষ্টি হবে, এটাও তারা ভাবেন না। কারণ তারা তো এখন বিদ্যুৎ পেয়ে গেছেন। যখন ১০ ঘণ্টা, ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেতেন না, তখন হয়তো বিদ্যুতের চাহিদাটা তারা বুঝতেন।’
আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ গেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই বিদ্যুতের জোরে ঘরে ঘরে টেলিভিশন চলছে। আর এই বেসরকারি খাতে টেলিভিশন আমিই উন্মুক্ত করে দিয়েছি। সেখানে বসেই তারা সমালোচনা করে যাচ্ছেন। যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা দিই, তখনো সমালোচনা শুনতে হয়েছে। কিন্তু আজকে সেই ডিজিটাল বাংলাদেশের প্ল্যাটফরম নিয়েই কিন্তু তারা আমাদের সমালোচনা করে যাচ্ছেন।’
কিছু লোকের সব সময় সমালোচনা করা অভ্যাসে পরিণত করেছেন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যত ভালো কাজ করেন না কেন, নিজেদেরটা তারা দেখে, নিজেদেরটা তারা বোঝে। কিন্তু জনগণের ভালো-মন্দ বোঝে না।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আইয়ুব খানের আমলে ১৯৬২ সালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার কথা থাকলেও পরে দুটোই পশ্চিম পাকিস্তানে করা হয়। এতে বরাবরের মতোই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছিল। আজকে আমরা সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছি। এর বিদ্যুৎ যখন আসবে, সেটা তো আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে। অর্থনীতি আরও সচল হবে, আরও চাঙা হবে এবং এটা তো সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। কাজেই এটা নিয়ে এতে সমালোচনা কেন?’
পদ্মা সেতু নিয়ে সমালোচনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক কথা। তারপর এলো পদ্মা সেতুর রেললাইন, ৪০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে পদ্মা সেতুর রেললাইন করার কী দরকার ছিল। কারা চড়বে এই রেললাইনে। আমি অপেক্ষা করছি, রেললাইন যখন চালু হবে, তখন কেউ চড়ে কিনা। তখন এই মানুষগুলোকে আমার মনে হয় ধরে নিয়ে দেখানো দরকার যে, এই রেলসেতুতে মানুষ চড়ে কিনা।’
নিজস্ব অর্থায়নে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য একটি টাকাও কারও কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়নি বা ধার করা হয়নি। এটি বাংলাদেশের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে করা হচ্ছে। একেবারে সরকারি কোষাগার থেকে টাকা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে।
সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্যে সরকারপ্রধান বলেন, ‘তারা অর্বাচীনের মতো একেকটা কথা বলবে, আর মিথ্যা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করবে; এটা কিন্তু গ্রহণ করা যায় না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যাই করবেন, বলবে এটার কী দরকার ছিল। তাদের জন্য দরকার না থাকতে পারে, আমাদের দেশের মানুষের জন্য দরকার আছে। কারণ আমরা, তাদের মতো দুই-চারজন, যারা দেশের অর্থসম্পদ ভোগ করে-তাদের কথা আমরা ভাবি না। ভাবি-দেশের তৃণমূলের মানুষ যারা অসহায়, যারা শোষিত, যারা বঞ্চিত-আমি তাদের কথা ভাবি। তাদের কল্যাণ যাতে হয়, আমরা সেটা দেখি। শুধু বড়লোকদের দুই-চারটা ছেলেমেয়ে কম্পিউটার ব্যবহার করবে; আর আমার গ্রামের ছেলেমেয়েরা ব্যবহার করবে না, সেটা তো হয় না।’
১৯৮১ সালের ১৭ মে জোরপূর্বক নির্বাসিত জীবন থেকে ফিরে আসার দিনটির কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যখন আমি বিমানবন্দরে অবতরণ করি, তখন আমি আমার নিকটাত্মীয়দের কাউকে পাইনি, কিন্তু লাখো মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই আমার একমাত্র শক্তি এবং আমি এই শক্তি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি।’
দেশে ফেরার পর তিনি দেশব্যাপী সফরের সময় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘তবে আমি বাংলাদেশের মানুষের আস্থা, ভালোবাসা পেয়েছি। কত অপপ্রচার, কত কথা, কত কিছু তারপরও বাংলাদেশের জনগণ আমার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণের এবং এ মুহূর্তে দেশের জন্য যেটা দরকার সেই প্রকল্প গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে টাকা খরচ ও সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানান। করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং দেশে দেশে মুদ্রাস্ফীতি এবং খাদ্য সংকটের প্রসঙ্গ টেনে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশবাসীকে মিতব্যয়ী হওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সারা বিশ্বের উন্নত এবং অনুন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে এবং দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ইউরোপের অনেক দেশ আছে যেখানে ১৭ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। জার্মানির মতো জায়গায় ভোজ্যতেলের অভাব। একমাত্র অলিভ অয়েল ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় তেল নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, এক লিটারের বেশি কেউ নিতে পারবে না। আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি ৮ ভাগের ওপরে উঠে গেছে, ১০ ভাগে উঠে যাবে। ১ ডলারের ডিজেল-পেট্রোলের দাম ৪ ডলারে উঠে গেছে।
তিনি বলেন, অনেক জায়গায় এখন মানুষের একবেলা খেতেই কষ্ট হচ্ছে এবং সারা বিশ্বেই এই অবস্থা বিরাজমান। তারপরও তার সরকার এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হলেও আমদানিনির্ভর এসব পণ্যের প্রভাব তো অর্থনীতিতে পড়বেই। কারণ উৎপাদন যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি শিপমেন্ট ব্যয় বেড়ে গেছে। যে কারণে দেশের ভেতর একটু মূল্যস্ফীতি বা জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবাইকে এটুকু অনুরোধ করব যদি একটু সাশ্রয়ী হন, মিতব্যয়ী হন বা সব ব্যবহারে যদি একটু সতর্ক হন তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।