পদ্মা সেতু চালু হলে শুধু যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই নয়, বৈচিত্র্য আসবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন ব্যয়সহ বিভিন্ন খাতে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে একদিকে যেমন দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগসূত্র তৈরি হবে, ঠিক তেমনি এই সেতু ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে কৃষিজাত পণ্যের বাজারজাতকরণে পরিবহনের ক্ষেত্রে। সেতুর কারণে কৃষক তার পণ্যের সঠিক মূল্য পাবেন।
পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ কতভাবে উপকৃত হতে পারে, তা নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। চলতি বছর মে মাসে পদ্মা সেতুর দুই পাশের তিন জেলা মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ৭৫০ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে আইএমইডি। যার মধ্যে ৯৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতের ফলে সঠিক মূল্য পাওয়া যাবে। ৯৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, কৃষিজাত পণ্য বাজারজাতকরণে পরিবহন সুবিধা হবে।
ফরিদপুরে খেত থেকে মুলা তুলছেন এক কৃষক
ফাইল ছবি
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষার সূত্র ধরে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মাদারীপুরের শিবচরের বেশ কয়েকজন কৃষকের। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম মোহাম্মদ বাদশা মিয়া। তাঁর ভাষ্য, মাদারীপুরে এই সময়ে প্রচুর পেঁয়াজ, মসুরি, শর্ষে, ধনিয়াসহ বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত। পাশাপাশি কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, অনেক সময় ফেরি বন্ধ থাকে। তাই তাঁদের কৃষিজাত পণ্য বাজারজাত করতে সমস্যা হয়। অনেক সময় বাজারজাত করতে না পারার কারণে কৃষিজাত পণ্য পচে যায়।
বাদশা মিয়া বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে গেলে তখন আর ফেরির বিষয় থাকবে না। কম সময়ে পণ্য বাজারজাত করা যাবে।
গত বুধবার কথা হয় শিবচরের মাদবরেরচর ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য রানু আক্তারের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক। এ ছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা তাঁর।
পরিবহন খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৬ শতাংশ বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে পরিবহন খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
কুয়াশার কারণে অনেক সময় ফেরি বন্ধ থাকে। তাই পারাপারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই অনেক সময় কৃষি পণ্য ট্রাকেই পঁচে যায়
ফাইল ছবি
আইএমইডি থেকে উত্তরদাতাদের কাছে তাঁদের বর্তমান মাসিক আয়ের তথ্য জানতে চাইলে বেশির ভাগই উত্তর দিয়েছেন, তাঁদের মাসিক আয় গড়ে ১৫ হাজার টাকা। তবে পদ্মা সেতু হলে এই আয় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে।
উত্তরদাতাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, পদ্মা সেতু চালু হলে কোথায় কোথায় কর্মসংস্থান হতে পারে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ বলেছেন, গাড়িচালক হিসেবে মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ৪২ শতাংশ বলেছেন, নতুন নতুন শিল্পকারখানায় কর্মসংস্থান হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার কথা বলেছেন ৩৭ শতাংশ। ইজিবাইক ও অটোরিকশার কথা বলেছেন ৪৯ শতাংশ। সিএনজির কথা বলেছেন ৩৭ শতাংশ।
ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দক্ষিণাঞ্চলে
আইএমইডির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পদ্মা সেতু চালু হলে স্কুল–কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে। মেয়েদের স্কুল–কলেজে যাওয়ার হার বাড়বে। স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাতায়াত সুবিধা হবে। নারীদের কাজের সুবিধা বাড়বে।
পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, জানতে চাইলে শিবচরের বাখরেরকান্দি পদ্মা সেতু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, সব দিক দিয়েই দক্ষিণাঞ্চল এখনো অবহেলিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব দিকেই পিছিয়ে। তবে পদ্মা সেতুর কাজ হয়ে গেলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। যানজট কমে আসবে। ফেরিতে দুর্ভোগ আর ভোগান্তি থাকবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। নতুন নতুন শিল্পকারখানা হবে দক্ষিণাঞ্চলে। তখন সেখানে কর্মসংস্থান হবে। কম সময়ে অল্প খরচে যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হবে।
সোহেল রানা আরও বলেন, কৃষিজাত পণ্যসহ যেকোনো পণ্য সহজে আনা–নেওয়া যাবে। পদ্মা সেতুর দুই পারে জমির মূল্য বাড়বে। স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দক্ষিণাঞ্চলের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ওপরে।