ডেস্ক নিউজ
সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু সূচক ভালো হচ্ছে। রপ্তানি আদেশ পাচ্ছে পোশাক খাত। খুলেছে কলকারখানা। উৎপাদনে বেড়েছে গতি। রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ। আর কৃষি খাত তো বন্ধ হয়নি কখনোই। সব মিলিয়ে কোভিড-১৯ বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে। পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর বাতাস বইতে শুরু করেছে। প্রতিটি দেশই নতুন করে অর্থনীতির হিসাব কষছে। এর বাইরে নেই বাংলাদেশও। ইতোমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে গ্যাস ও বিদু্যতের ব্যবহার বেড়েছে। আর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বেড়েছে কনটেইনার লোড-আনলোডের সংখ্যা, যা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ নিয়ে শঙ্কিত আছেন সবাই। দোকানপাট, শপিং মল, অফিস-আদালত, ছোট-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, শিল্পকারখানা ও সড়ক, নৌ, রেল, আকাশপথের পরিবহণসহ সবকিছু খুলে দেওয়ায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেও এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে। শ্রমজীবীরাও যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। শুধু তা-ই নয়, মানুষের মনের এ স্বস্তি সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে শুরু হয়েছে পুরোদমে উৎপাদন। ব্যাংকে বিনিয়োগের খরা কাটছে, আশা জাগাচ্ছে পর্যটন, চাঙ্গা শেয়ারবাজার, জমে উঠেছে কেনাবেচা, বেড়েছে রপ্তানি আয়। জানতে চাইলে পোশাক রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএর) সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে। স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হচ্ছে। ঘরবন্দি থেকে মানুষ বের হচ্ছেন। তবে টিকাকরণের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানগুলো আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মানুষ কাজ করছে। তবে মানুষের মনে অজানা একটা আতঙ্ক তো রয়েছেই। যদিও সেটা আগের চেয়ে অনেকটা কম। আর শিল্প খাতের উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়ে গেছে। বিক্রি তেমনভাবে শুরু না হলেও সবকিছু খুলে গেছে। এটি ইতিবাচক। আশা করা যায়, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। জানতে চাইলে এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর তারিক আফজাল বলেন, সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এ জন্য বেসরকারি ঋণে চাহিদা তৈরি হয়েছে। সরকারঘোষিত প্রণোদনার ঋণ ছাড়াও ব্যক্তি বিনিয়োগে খরা কাটছে। ব্যাংকগুলো এখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নে ঋণ বিতরণে আগের থেকে বেশি মনোযোগী। সামনের দিনে ঋণে গতি ফিরবে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র শিল্পে অর্থায়নের জন্য ব্যাংকগুলোতে চাপ সৃষ্টি করছে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঋণের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু কোভিডের তৃতীয় ঢেউ যদি দেশে আঘাত হানে তবে আগামী দিনগুলো অনিশ্চিত। অর্থনীতি যে ভালো হচ্ছে তার অন্যতম সূচক হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ। মহামারি করোনাভাইরাসের আঘাতে বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মধ্যেও আশা জাগাচ্ছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার এ সঞ্চয়ন (রিজার্ভ)। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যনুযায়ী, আমদানি ব্যয় বাড়ার পরও রিজার্ভ এক লাফে ৪৮ বিলিয়ন (৪ হাজার ৮০০ কোটি) ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে, যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এদিকে করোনার ধাক্কায় দেশে বিনিয়োগের যে খরা তৈরি হয়েছিল, তা কাটতে শুরু করেছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় ঋণের জন্য আবেদন বাড়ছে। বেড়েছে বিতরণও। ফলে ব্যাংকে যে অতিরিক্ত তারল্যের পাহাড় জমেছিল, তা ছোট হতে শুরু করেছে। গত বছরের মার্চে করোনার আঘাতের পর বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ তলানিতে নামে। অর্থনীতির ওপর আঘাত মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, তার বাইরে ঋণ প্রস্তাব ছিল না বললেই চলে। এরই মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা কাটিয়ে উদ্যোক্তারাও উৎপাদন শুরু করার এবং নতুন কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছেন। উদ্যোক্তা জানান, ঋণ পেতে যে সমস্যা ছিল তা এখন ধীরে ধীরে কাটছে। বিশেষ করে বড় উদ্যোক্তারা এত দিন স্বল্প সুদে ঋণ পেলেও, বঞ্চিত হয়েছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তারা। সাম্প্রতিক ব্যাংক ঋণের তথ্য বলছে, পাল্টাচ্ছে ঋণ বণ্টন চিত্র। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মোট ঋণ ছিল ১২ লাখ ১৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে এ ঋণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে বিতরণ বেড়েছে ৫৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে বেশির ভাগই বিতরণ হয়েছে দ্বিতীয় প্রান্তিকে মার্চ থেকে জুনের মধ্যে। এ সময়ে মোট বিতরণ হয়েছে ৩৫ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। মার্চ শেষে ঋণ ছিল ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে বিতরণ হয়েছিল কেবল ১৮ হাজার টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিতরণ বেড়েছে দ্বিগুণ। অপরদিকে, করোনার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে দেশের পণ্য রপ্তানি আয়ও। মহামারির ধাক্কায় গত এপ্রিল, মে ও জুন মাসে রপ্তানি কমলেও জুলাইয়ে দশমিক ৫৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আগস্টে এসে রপ্তানি ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ বেড়েছে। ওই মাসে রপ্তানি হয়েছে ২৯৬ কোটি ৭১ লাখ ডলারের পণ্য। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ২ মাসে ৬৮৭ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ আয় আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের প্রথম ২ মাসে ৬৭৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার কারণে বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে পণ্য রপ্তানি ধাক্কা খেয়েছে। তবে তৃতীয় প্রান্তিকে পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। বাতিল ও স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশের পণ্যও যাচ্ছে। সে জন্য পণ্য রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ফলে সংকট কাটিয়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। এছাড়া শেয়ারবাজারে চাঙ্গাভাব অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই ভাঙছে রেকর্ড। দেশের ইতিহাসে সূচক ও বাজার মূলধনে সর্বোচ্চ অবস্থান বিরাজ করছে। ঢাকার শেয়ারবাজারের লেনদেন তিন হাজার কোটি টাকার হাতছানি দিচ্ছে। সূচক ৭ হাজার পয়েন্ট পেরিয়ে গেছে। বাজার মূলধন ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই বাজারে নতুন করে বিনিয়োগকারী আসছেন। দীর্ঘ বন্ধের পর গত ১৯ আগস্ট থেকে খুলছে পর্যটনকেন্দ্র, হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত, সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার পর্যটনকেন্দ্র আবার পর্যটকে মুখরিত। ফলে এ খাতে বড় ধরনের আর্থিক গতি পেয়েছে। আবার, দীর্ঘ বিরতির পর ফুটপাতে দোকান খোলার সুযোগ পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। শুরুতে ক্রেতা কম এলেও ধীরে ধীরে বাড়ছে। করোনার আগে গুলিস্তানজুড়ে এসব দোকানে প্রতিদিন যেখানে প্রায় কোটি টাকার কেনাবেচা হতো, লকডাউনের পর সেই বেচাবিক্রি অবশ্য আগের অবস্থায় ফেরেনি। তবে করোনা মহামারির মধ্যে গত দেড় বছর ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালোই ছিল। সংকটের সময়েও প্রবাসীরা রেকর্ড পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন ঘটেছে। পরপর দুই মাস কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের পুরোটা সময়জুড়েই আগের বছরের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে হঠাৎ করে রেমিট্যান্স কমে গেছে। এই ধারাবাহিকতা আগস্টেও দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, জুলাই ও আগস্ট-এ দুই মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ৩৬৮ কোটি ১৬ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ৪৫৬ কোটি ২১ লাখ ডলার। তুলনা করলে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। এদিকে হঠাৎ প্রবাসী আয় কমে যাওয়াকে নানাভাবে বিশ্লেষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ডক্টর জায়েদ বখত বলেন, লকডাউন চলাকালে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। তখন হুন্ডিও বন্ধ হয়ে যায়। প্রবাসীরা বাধ্য হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে উড়োজাহাজ চলতে শুরু হওয়ায় আবার হুন্ডি বেড়েছে। তবে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে অনেক দেশে এখনো লকডাউন চলছে। এতেও প্রবাসীদের আয় কমেছে। তবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ডক্টর আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, হুন্ডি বেড়ে যাওয়াতেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমেছে। আবার করোনার কারণে দেশে ফেরা প্রবাসীদের অনেকেই বিদেশে যাননি। এভাবে রেমিট্যান্স কমতে থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা আছে। অবশ্য ডক্টর জায়েদ বখত মনে করেন, দুই মাসের হিসাব নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারণ, রপ্তানি আয় বাড়ছে। উলেস্নখ্য, মহামারি করোনা নিয়ন্ত্রণে দফায় দফায় লকডাউন ও বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি ও জনজীবন। করোনার প্রকোপ কমে আসায় সরকার লকডাউন ও বিধিনিষেধ থেকে সরে আসে। চালু হয় শিল্পকারখানা ও ব্যবসাবাণিজ্য। গত ১১ আগস্ট থেকে সাধারণ মানুষের জন্য পরিবহণ উন্মুক্ত হয়। ওই দিন থেকেই অফিস আদালত ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়।