ডেস্ক নিউজ
আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনার রেশ না কাটতেই এবার অভিযোগ উঠেছে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না হলেও কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু করার।
শুকুর আলীর আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লার অভিযোগ, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার আগেই শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে। অথচ তিনি আপিল বিভাগের রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদনের জন্য পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষা করছেন।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির অপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চে গতকাল রোববার আসামিপক্ষে এ অভিযোগ করা হয়। এ পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের সাজা কার্যকরের প্রক্রিয়া নিয়ে পরবর্তী সময় গাইডলাইন দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা শুকুর আলীর সাজা কার্যকর প্রক্রিয়া স্থগিত করতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার আগে কোনো আসামির ফাঁসি কার্যকর করা যাবে না।
এর আগে গত ৩ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তির আগেই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে চুয়াডাঙ্গার দুই আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়, যা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং যশোর কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আইনগত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই আসামি আব্দুল মোকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ূর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। অবশ্য এ বিষয়ে আগামীকাল মঙ্গলবার আদেশের দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ।
এদিকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া শুরু করাকে ‘অবিচার’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড, শাহ্দীন মালিক। তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে যে পাঁচটি দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এখন কারাগারের কনডেম সেলেও প্রায় দুই হাজার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগে তাদের মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছেন। এত মৃত্যুদণ্ডের আপিল শোনা হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগের বিচারিক ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। এ জন্য আসামিদের বহু বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এক দশকের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অবিচার এবং বিভিন্ন কারণে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। যখন এসব অবিচারের তথ্য প্রকাশ হচ্ছে, তখন রাষ্ট্র ভুল শিকারের পরিবর্তে এর সাফাই গাচ্ছে। এটি জাতীয় দুর্ভাগ্য।’
শাহ্দীন মালিকের মতে, এখন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের সুবিচার কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, সেদিকেই সংশ্নিষ্টদের নজর দিতে হবে। অন্যথায় গণতান্ত্রিক বিশ্বে আমরা বর্বর শাস্তির পশ্চাৎপদ দেশ হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে আখ্যায়িত হবো।
শুকুর আলীর বিরুদ্ধে করা মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ রাতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার লালনগর গ্রামের ১৩ বছর বয়সী এক শিশু প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে টেলিভিশন দেখে বাড়ি ফেরার পথে অপহৃত হয়। অপহরণকারীরা পরে লালনগর ধরমগাড়ী মাঠের একটি তামাক ক্ষেতে নিয়ে তাকে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এ ঘটনায় পরদিন ভিকটিমের বাবা পাঁচজনকে আসামি করে দৌলতপুর থানায় মামলা করেন।
ওই মামলার বিচারের ধারাবাহিকতায় ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট এক রায়ে চার আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। তারা হলো- কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার লালনগর গ্রামের খয়ের আলীর ছেলে শুকুর আলী, পিজাব উদ্দিনের ছেলে নুরুদ্দিন সেন্টু, আবু তালেবের ছেলে আজানুর রহমান ও সিরাজুল প্রামাণিকের ছেলে মামুন হোসেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে করা জেল আপিলের শুনানি নিয়ে গত ১৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং অন্য তিন আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। এই তিন আসামিকে কারাগারের কনডেম সেল থেকে সাধারণ সেলে স্থানান্তরেও কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও পূর্ণাঙ্গ রায় অর্থাৎ লিখিত রায় এখনও প্রকাশ হয়নি। এরই মধ্যে আপিল বিভাগের অ্যাডভান্স অর্ডার অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত আদেশ কুষ্টিয়ার বিচারিক আদালত হয়ে কারাগারে পৌঁছেছে। যার ভিত্তিতে কারা কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে আসামি শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। রাষ্ট্রপতি তার প্রাণভিক্ষার আবেদন নামঞ্জুর করেছেন।
এ পরিস্থিতিতে পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর রিভিউ আবেদন করার কথা আপিল বিভাগে তুলে ধরেন শুকুরের আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা। এর পর মৌখিক আদেশে অপিল বিভাগ শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া স্থগিতের আদেশ দেন।
এ প্রসঙ্গে হেলাল উদ্দিন মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, সর্বোচ্চ আদালতকে বলেছি যে, রিভিউ আবেদন করার আগে যেন আমার আসামির ফাঁসি কার্যকর করা না হয়। আদালত আমার এ প্রার্থনা বিবেচনায় নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে একটি আবেদন করতে বলেছেন। এ সময় আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেছেন আইজি প্রিজন্সকে বলে দিতে যে, আপাতত ফাঁসি কার্যকরের সিদ্ধান্ত যেন স্থগিত রাখা হয়।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুকুর আলীর আইনজীবী আপিল বিভাগকে জানিয়েছেন, তার আসামির আপিল ডিসমিস (খারিজ) হয়েছে। কিন্তু তারা এখনও পূর্ণাঙ্গ রায় পাননি। রায় পেলে তারা রিভিউ করতে পারবেন। কিন্তু এর আগেই নাকি আসামির ফাঁসি কার্যকরের পদক্ষেপ নিচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। তখন আদালত আইজি প্রিজন্সকে বলতে বললেন- পূর্ণাঙ্গ রায়ের আগে যেন ফাঁসি কার্যকর করা না হয়। এ ছাড়াও সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, পরে বিষয়টি আমাদের কাছে (আদালতে) এলে একটা গাইডলাইন দিয়ে দেবেন।’