সভ্যতার শুরু থেকেই মানবজাতির মধ্যে মহাশূন্য নিয়ে ছিল বিপুল আগ্রহ। আমাদের গ্রহের বাইরে কি আছে তা জানার এই অদম্য ইচ্ছা থেকেই শুরু হয় গবেষণা। স্থাপন করা হয় স্পেস সেন্টার। আমরা সবার মধ্যেই পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে যাবার ইচ্ছে থাকলেও গুটি কয়েক মানুষের কপালেই জুটেছে এই সৌভাগ্য। যে মানুষটি প্রথম এই সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তার গল্পটা একই সাথে জয়ের এবং বেদনার।
বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে, এমন রকেট আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছিল যা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পরাস্ত করতে পারে। মহাকাশে পারি জমানোর মানুষের বহুদিনের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ ছিল এটি।
৪ অক্টোবর ১৯৫৭, ইতিহাসে প্রথম বারের মতো মানুষ কোন বস্তুকে মহাকাশে পাঠাতে সক্ষম হয়। সোভিয়েত স্যাটালাইট স্পুটনিক ১ পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো প্রথম কোন কৃত্রিম বস্তু। স্পুটনিক ১- এর ওজন ছিল ৮৩ কেজি, এটি ২৩ ইঞ্চি প্রসস্ত ছিল। স্যাটালাইটটি টানা ২২ দিন পর্যন্ত রেডিও সিগন্যাল পাঠাতে থাকে। এর তিনটি সিলভার জিংক ব্যাটারি শেষ হয়ে যাবার পর ও প্রায় ২ মাস এটি কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। ৪ জানুয়ারি ১৯৫৮ সাথে এটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
পুরো বিশ্বের জন্য এই ঘটনা ছিল তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো। বিশেষ করে আমেরিকার জন্য। সোভিয়েতদের এই মহাকাশ মিশন আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে কোল্ড ওয়ার এর সুচনা করে। এর ফলশ্রুতিতে আমেরিকা নাসা ও ডারপা প্রতিষ্ঠা করে। আমেরিকানরা আরও একটি প্রোজেক্ট শুরু করে যার নাম আরপানেট। এই আরপানেটি থেকেই আজকের মডার্ন ইন্টারনেটের সূত্রপাত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এখানেই থেমে থাকে নি। ১২ এপ্রিল ১৯৬১, সোভিয়েতরা ভসটক ১ নামের একটি স্পেসক্র্যাফট লঞ্চ করে। এই ভসটক ১ স্পেস্ক্রাফট এ পাইলট ছিলেন সোভিয়েত কসমোনাট, ২৭ বছর বয়সী ইউরি আলেক্সেভিচ গাগারিন। এই মিশন তাকে বানায় বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী।
ভসটক ১ সর্বচ্চ ২০২ মেইল উচ্চতায় মাত্র ৮৯ মিনিটের জন্য পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে। ভসটক ১ এ ছিল একটি গোলাকার কেবিন। স্পেসক্র্যাফটটিতে একটি ছোট জানালা ও রেডিও এন্টেনা ছিল। কেবিনের ভেতরে রেডিও, প্রয়োজনীয় ইন্সট্রুমেন্টস ও একটি ইজেকশন সিট ছিল। ভসটক ১ এর কন্ট্রোল সিস্টেমটি ছিল পুরোপুরি অটোম্যাটিক।
ইউরি আলেক্সেভিচ গাগারিন পুরো মিশনে চুপচাপ ছিলেন। মহাকাশে গাগরিনের এক ঘন্টা ৪৮ মিনিটের ভ্রমনে কেবলমাত্র একটি বক্তব্যই রিসিভ করা হয় যেখানে তিনি বলেন “ফ্লাইট স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলেছে; আমি ভাল আছি.”। এই মেসেজটি রিসিভ করার সময় ভসটক ১ ৮ কিমি/সে। এ চলছিল। পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করার পর স্পেসক্র্যাফটটি কাজাকিস্থানে ল্যান্ড করে।
ফিরে আসার পর ইউরি গাগারিন রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। রাশিয়ায় তাঁর সৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়, তাঁর নামে রাস্তার নামকরণ করে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই বিশাল সফলতা অ্যামেরিকার গালে ছিল কড়া চপেটাঘাত। এর ঠিক এক মাস পরেই আমেরিকা এস্ট্রোনাট এলান শেপার্ড কে নিয়ে তাদের প্রথম মহাকাশ মিশন লঞ্চ করে। এলান শেপার্ড পৃথিবীর কক্ষপথের অর্ধেকটা ভ্রমন করতে সক্ষম হন।
সোভিয়েতরা ৬ আগস্ট ১৯৬২ সালে আরও একটি বড় ধাক্কা দেয় আমেরিকাকে। তারা ভসটক ২ স্পেসক্র্যাফট এ করে ঘেরম্যান টিটোভ নামের একজন কস্মোনাটকে মহাকাশে পাঠায়। এই মিশনে ভসটক ২ প্রায় ২৫ ঘন্টায় পৃথিবীকে ১৭ বার প্রদক্ষিণ করে।
২০ ফেব্রুয়ারী ১৯৬২ সালে স্পেসক্র্যাফট ফ্রেন্ডশিপ ফেভেনে আমেরিকান আস্ট্রোনাট জন গ্লেনের ঐতিহাসিক মহাকাশ যাত্রা তাকে প্রথম আমেরিকান মহাকশচারী বানায়। তিনি পৃথিবীর কক্ষপথ ৩ বার প্রদক্ষিণ করেন।
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বুঝতে পারেন যে তাঁর দেশের মানুষদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো প্রয়োজন। তখন তিনি ঘোষণা করেন যে আমেরিকা সেই দশকের শেষেই চাঁদে পাড়ি দিতে সক্ষম হবে।
২৭ মার্চ ১৯৬৮, ইউরি গাগারিন সকালে চকলোভস্কি এয়ার বেসে যান তাঁর রেগুলার ফ্লাইট ট্রেইনিং এর জন্য। গাগরিন ফ্লাই কসমোনাট হিসেবে নিজের দায়িত্ব শেষ হবার পর আবারও পাইলট হিসেবে কাজ করার জন্য ট্রেইনিং নিচ্ছিলেন। সেদিন সকালেও তিনি মিগ ১৫ বিমানে কয়েকবার টেস্ট ফ্লাই করার উদ্দেশ্যেই এয়ার বেসে যান। কিন্তু সেদিন যা ঘটতে যাচ্ছিল তা ছিল আসলেই রহস্যময় ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
সেদিন এয়ার বেসের আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল। প্রচুর বাতাস ও বৃষ্টি ছিল। সবকিছু মিলে গাগারিনের ঠিক ভাল ঠেকছিল না। কিন্তু তারপর ও তিনি সফলভাবে তাঁর মিগ ১৫ ফ্লাই করেন। কসরত শেষে তিনি তাঁর বেসে রেডিও তে জানিয়ে দেন তিনি কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসছেন। কিন্তু ২ ঘন্টা পার হওয়ার পর ও যখন তিনি ফিরে আসলেন না, তাকে খোঁজার জন্য সার্চ অপারেশন শুরু করা হয়। সার্চ টিম আকাশ থেকে মাটিতে পরে থাকা প্লেনের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পান। তারা ধারনা করেন গাগারিন হয়তো ক্রাশ করার আগেই প্লেন থেকে সিট ইজেক্ট করে বেড়িয়ে পরেছিলেন। কিন্তু তাদের ধারনা ভুল প্রমানিত হয় যখন পরের দিন গাগারিনের বডি পাওয়া যায়।
অনেক তদন্তের পর ও সোভিয়েত ইউনিয়ন গাগারিনের মৃত্যুর রহস্যের কোন কিনারা করতে পারে না। ধারনা করা হয় গাগারিন হয়ত কোন পাখিকে এড়াতে গিয়ে অথবা আবহাওয়ার কারণে প্লেনের কন্ট্রল হারান। এই ঘটনা নিয়ে খুব কম নিউজ জনগণকে জানানো হয়। এতে করে অনেক কন্সপিরেসি থিয়োরির জন্য হয়।
কেউ কেউ বলে গাগারিন মাতাল অবস্থায় প্লেন চালাচ্ছিলেন। গাগারিনের মদ খাওয়ার অভ্যাস সম্পর্কে অনেকেই অবগত ছিল। প্রথম মহাকাশ যাত্রার পর থেকেই তাঁর মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ছোট এক গ্রামে মানুষ হওয়া গাগারিন হঠাৎ করে আসা এই খ্যাতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে তাঁর কাছে চিঠি আসতো। সবাই তাদের করুন অবস্থার কথা বর্ননা করে সাহায্য চাইতো গাগারিনের কাছে। মানুষের এত দুর্দশার কথা জানার পর গাগারিন ঠিক থাকতে পারতেন না। তখন থেকেই তিনি অতিরিক্ত মদ পান শুরু করেন।
আরেকটি থিয়োরি বলে গাগারিন সি আই এ এর এজেন্ট ছিল এবং তাকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করা হয়। আরও একটি গুজব ছড়ায় যে গাগারিন আসলে সেই ক্র্যাশ থেকে বেচে যান ও সবার কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন। তবে সবচেয়ে অবাক করা থিয়োরি হচ্ছে, অনেকেই এটা বলে যে গাগারিন কোন ইউএফ ও কে এড়াতে গিয়ে প্লেন এর কন্ট্রোল হারান।
আসলেই সেদিন কি হয়েছিলো ইউরি গাগারিনের সাথে?
২০১৩ তে এসে এই ক্র্যাশের আসল কারন জানা যায়। সেদিন গাগারিনের প্লেনের সামনে এসে পরে আরও একটি বড় প্লেন Sukhoi Su-15। সেটাকে এড়াতে গিয়েই গাগারিন প্লেন এর কন্ট্রোল হারান। সোভিয়েত এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল এই ঘটনায় এতটাই লজ্জিত ছিল যে সত্য নিউজটা জনগণকে জানতে দেয় নি।
মারা যাওয়ার সময় গাগারিনের বয়স ছিল মাত্র ৩৪ বছর।