ডেস্ক নিউজ
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ বড় সংশোধনী আনার প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোট কেন্দ্রে পেশিশক্তির ব্যবহার রোধে নতুন আটটি ধারা সংযোজনসহ মোট ১৯টি বিষয়ে সংশোধনীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নতুন ছয়টি ধারাই ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত। পাশাপাশি পক্ষপাতদুষ্ট বা আইন লঙ্ঘনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনী কাজে বাধা দানকারীর শাস্তি এবং গণমাধ্যমকর্মী, পর্যবেক্ষক, ভোটারদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পেশিশক্তির ব্যবহার চিরতরে বন্ধ করতে একাধিক নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করেছে ইসি। এসব ধারা-উপধারায় সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল ও জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনী প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই (ভেটিং) করছে আইন মন্ত্রণালয়। তাদের সম্মতি সাপেক্ষে অনুমোদনের জন্য শিগগিরই মন্ত্রিসভায় আইনটি উপস্থাপন করা হবে।
আগামী বছর নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচন সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনীর উদ্যোগ গ্রহণ করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এই সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের আগে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সংলাপ করে ইসি। এতে ভোটে পেশিশক্তির প্রভাব, ভোট কেন্দ্রে অযাচিত লোকের হস্তক্ষেপ, পোলিং এজেন্টদের আসতে বাধা, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের অনিয়মসহ সুষ্ঠু নির্বাচনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ উঠে আসে সংলাপে। রাজনৈতিক দলসহ সব ধরনের অংশীজনের সঙ্গে সংলাপে প্রাপ্ত কিছু সুপারিশের প্রস্তাবও আরপিও সংশোধনের খসড়ায় রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনে পোলিং এজেন্টদের ভোট কেন্দ্র আসতে বাধা বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র দখল, ভোটার ও পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানোসহ ব্যাপক হারে পেশিশক্তির প্রদর্শনীর ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য ভোটার ও পোলিং এজেন্টদের সুরক্ষার ব্যাপারে এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইসি। কোনো ব্যক্তি অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কোনো ব্যক্তিকে নির্বাচনী কাজে বাধা দিলে বা বাধার চেষ্টা করলে শাস্তির আওতায় আনতে ৭৭ অনুচ্ছেদে উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ভোট কেন্দ্রে পেশিশক্তির ব্যবহার রোধে ২৫ অনুচ্ছেদে নতুন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। পোলিং এজেন্টদের আসতে বাধা বা কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পেলেও দায়ীদের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের শাস্তির আওতায় আনতে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনী কার্যক্রমে গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও অবৈধ পেশিশক্তি প্রয়োগ হলে দায়ীদের সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল ও অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভোট কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের আসতে ভয়ভীতি প্রদর্শন, বাধা বা কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পেলে দায়ীদের সর্বোচ্চ সাত বছরের শাস্তির আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভোট অনিয়মে জড়িত পক্ষপাতদুষ্ট প্রিসাইডিং অফিসারদেরও সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ভোটের সময় কোনো অভিযোগ পেলে কমিশন খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারে বিদ্যমান আইনে। এখন ভোটের সময়ের পর থেকে ফলাফল প্রকাশের পর, এমনকি গেজেট প্রকাশের আগে নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ের অভিযোগ কমিশন তদন্ত করে অনিয়মের প্রমাণ পেলে ভোট বাতিল করতে পারবে- এমন দুটি উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচনী কার্যক্রমে পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নতুন উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের বিরুদ্ধে পেশিশক্তি ব্যবহারকারীদের সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল ও জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোট দিতে বা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়েও উপধারা সংযোজন করা হয়েছে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে। ভোটারদের ভোটদানে বাধা প্রদান বা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য পেশিশক্তির ব্যবহার হলে সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল ও জরিমানা করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ভোট গণনার বিবরণী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও এজেন্টদের দেওয়া বাধ্যতামূলক করা, প্রার্থীদের আয়কর সনদ জমা দেওয়া এবং মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের দিন খেলাপি বিল ও ঋণ পরিশোধ করেই প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রাখা-সংক্রান্ত প্রস্তাবও রয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার প্রতিশ্রুতি ২০২০ সালে শেষ হয়েছে। নিবন্ধন শর্ত প্রতিপালনে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় দলগুলোকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় দিতে খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দলের সংশোধিত গঠনতন্ত্র জমার সময় এক বছর থেকে কমিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু ধারা-উপধারায় সংযোজন-বিয়োজন ও করণিক সংশোধনী প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালে দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার (আরপিও) শীর্ষক নির্বাচনী আইনটি (১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর-১৫৫) ইংরেজিতে প্রণয়ন করা হয়। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন আরপিও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলায় রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯৪ক অনুচ্ছেদের দেওয়া ক্ষমতাবলে ২০১২ সালের ১ জুলাই বাংলাপাঠ গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। তৎকালীন কমিশন বিদায়ের আগে আইন সংস্কারে উদ্যোগী হলেও নিজেদের দ্বন্দ্বে তা আর এগোয়নি। ১৯৭২ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ প্রণয়নের পর এ পর্যন্ত ১২ বার সংশোধন এসেছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে অন্তত ২১০টি বিষয়ে সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যালটের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন হয়।