ডেস্ক নিউজ
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের নাম এসেছিল ‘প্যারাডাইস পেপারস’ কেলেঙ্কারিতে। বেনামি প্রতিষ্ঠান খুলে যারা বিদেশে বিনিয়োগ করেছিলেন তাদের তথ্যই ফাঁস করা হয়েছিল প্যারাডাইস পেপারসে। এখানে নাম আসলেই নির্বাচনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে এমনটা না ভাবলেও নগরপিতা হবার আগে তাবিথ আউয়ালের ‘গোপন সম্পদের’ হিসেব খুঁজে বের করার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
২০১৭ সালের নভেম্বরে ফাঁস হওয়া নথিতে নাম ছিল তাবিথ আউয়ালের বাবা বিএনপির ভাইস চেয়ার্যামান আবদুল আউয়াল মিন্টু, মা নাসরিন ফাতেমা আউয়ালের। সেখানে ছিল তাবিথের দুই ভাই তাফসির মোহাম্মদ আউয়াল ও তাজওয়ার মোহাম্মদ আউয়ালের নামও। এ ঘটনার পর অর্থনীতিবিদ, দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়। তবে দুই বছর পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তবে সিটি করপোরেশন মেয়রের মতো এতবড় একটি গুরুত্বপূর্ন পদে প্রার্থীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগের যথাযথ তদন্তের দাবি করেছেন অনেকেই। দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে বলে তাদের অভিমত।
দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, শুধু তাবিথ আউয়াল এর বিষয়ে নয় বরং যাদের নাম এসেছিল তাদের বিষয় আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উচিত ছিল বিষয়গুলো খুঁটিয়ে দেখা। তালিকার দুইটা দিক আছে। একটা হচ্ছে তালিকায় নাম আসা মানে অভিযুক্ত না বা অপরাধি না। আর একটা হচ্ছে যাদের নাম আসছে তারা অবৈধ ভাবে সম্পদের মালিক হয়েছে কিনা সেটাও একটু খুঁটিয়ে দেখতে হবে। তবে যেহেতু তালিকায় নাম আসছে, স্বাভাবিক অর্থে বিভিন্ন দেশের অনেকেই এ তালিকায় আছে। অন্যান্য দেশে যাদের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এখনো। আমরা আইন প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে আশা করি তারা এ কাজটা করবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে তালিকায় নাম আসছে বলেই প্রার্থীতা বাতিল করার সুযোগ নেই। তবে নির্বাচন কমিশন ওই প্রার্থীর কাছ থেকে জবাবটা জানতে চাইতে পারে। নির্বাচন কমিশন জানতে চাইতে পারে যে, ওই প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদের বিবরণী আছে তার সাথে প্যারাডাইস পেপারসে যে তালিকা প্রদান করা হয়েছে তার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু আছে কিনা? থাকলে কেনো রয়েছে এটার একটা ব্যাখ্যা চাইতে পারে এবং তার প্রেক্ষিতে কমিশন একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ এখতিয়ারটুকু কমিশনের আছে।
তিনি আরো বলেন, সাধারণ মানুষ (নির্বাচনের ক্ষেত্র) এটাতো বিবেচনা করবে। কিন্তু বিষয় হচ্ছে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে এবং যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন আসছে । তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে জবাবদিহিতা আনার চেষ্টা করতে হবে। এটা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। আর যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আছে আর অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তাদেরতো জনপ্রতিনিধি হবার কোন সুযোগ নেই।
২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর ফাঁস হয় প্যারাডাইস পেপারেসের এক কোটি ৩৪ লাখ নথি। এসব নথি প্রথমে জার্মান দৈনিক সুইডয়েচে সাইটংয়ের হাতে আসে। পরে সেসব নথি ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) হাতে তুলে দেয় তারা। সব নথিই বারমুডাভিত্তিক আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান অ্যাপলবির। এসব নথি পর্যায়ক্রমে তদন্ত করে দেখছেন ৬৭টি দেশের ৩৮০ জন সাংবাদিক।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত ছোট্ট একটি এলাকা বারমুডা। জায়গাটি নামমাত্র করের বিনিময়ে ব্যবসা করার জন্য বা সহজেই কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য পরিচিত। এখানকার একটি ল ফার্মের নাম অ্যাপলবি। বারমুডায় যারা কোম্পানি নিবন্ধন করেছে, তাদের সব তথ্য ছিল অ্যাপলবির কাছে। অ্যাপলবির হাতে থাকা এসব গোপন নথির তথ্য ফাঁস হয়ে চলে যায় আইসিআইএজের কাছে।
প্যারাডাইস পেপারসে এনএফএম এনার্জি লিমিটেড নামের বারমুডায় নিবন্ধিত একটি কোম্পানির শেয়ারধারী হিসেবে আবদুল আউয়াল মিন্টার নাম আসে। এনএফএম এনার্জির শেয়ারধারী হিসেবে মিন্টুর স্ত্রী নাসরিন ফাতেমা আউয়ালের নামও আছে। আসে এ দম্পতির তিন ছেলের নাম। মিন্টু ছাড়াও প্যারাডাইস পেপারসে আসে ১১ ব্যক্তি ও বাংলাদেশ নামযুক্ত ১০টি প্রতিষ্ঠানের নাম। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই জ্বালানি খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। আবদুল আউয়াল মিন্টুর ব্যবসায়িক ওয়েবসাইট মাল্টিমুডবিডি ডট কম-এ এনএফএম এনার্জি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এনএফএম এনার্জি’ গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কারের কাজে নিয়োজিত দেশের অগ্রগণ্য একটি প্রতিষ্ঠান এবং শেভরন বাংলাদেশ লিমিটেডের একটি বিনিয়োগও। এটি দেশের ১২, ১৩ এ ১৪ নম্বর ব্লকের গ্যাস অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত।’
তবে প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশের পরপরই ওই ওয়েবসাইটটি বন্ধ হয়ে যায়।
প্যারাডাইস পেপারসে নাম আসার বিষয়ে সেই সময় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারকে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেছিলেন, ‘অনেক আগে শেভরনে আমার এক শতাংশ শেয়ার ছিল। এখন শেভরনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। শেভরনের সঙ্গে সম্পর্কের কারণেই হয়তো প্যারাডাইস পেপারসে আমার নাম এসেছে।’
প্যারাডাইস পেপারসে নাম আসার পর এ নিয়ে তদন্তে সরব হয়নি রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু যে ব্যক্তি কদিন পর সিটি মেয়র হতে যাচ্ছেন, একটি আর্থিক কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম থাকার বিষয়টি কী তদন্তের দাবি রাখে? প্যারাডাইস পেপারসের আগে ২০১৬ সালে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি হয়। মোসাক ফনসেকা নামে পানামার একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এক কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি ফাঁস করে।
বিশ্বজুড়ে আলোচিত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির ঘটনায় ওই বছরই বাংলাদেশি নাগরিকদের বিষয়ে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে আজমত মঈন নামের এক ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে ওই কেলেঙ্কারির তদন্তে খুব গতিশীলতা দেখা যায় নি।
অবশ্য এ বিষয়ে কিছুদিন আগে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘যাদের নাম প্যারাডাইস পেপারসে এসেছে তাদের বিষয়ে জানতে বিভিন্ন দেশে এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স রিকোয়েস্ট) পাঠানো হয়েছিল। এমএলএআর’র জবাব এখনো আসেনি। সে কারণে অনুসন্ধান শেষ করা যায়নি, অনুসন্ধানের গতি কিছু শ্লথ হয়েছে। তবে অনুসন্ধান চলছে।’
নগর–পিতা হিসেবে স্বচ্ছতা ও সততার বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ তা মনে করেন তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রার্থী যেই হোক, সে যদি দূর্নীতির সাথে জড়িত থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান থেকে খবর নেওয়া উচিত। আর নির্বাচনের কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযোগ থাকে তাহলে সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের দেখা উচিত বলে আমি মনে করি।