ডেস্ক নিউজ
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) প্রথম পুরো মেধাভিত্তিক নিয়োগের সুপারিশ করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। নজিরবিহীন ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ফসল কোটামুক্ত ৪০তম বিসিএসে চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছেন ১ হাজার ৯৬৩ জন। কোটার বাইরেও রেকর্ড সংখ্যক প্রার্থীর অংশগ্রহণ এবং তৃতীয় পরীক্ষক দিয়ে খাতা মূল্যায়নের কারণে এ বিসিএস পুরোটা সময় জুড়েই বহুল আলোচিত ছিল।
এই বিসিএস করোনা মহামারীর কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পিএসসিকে মৌখিক পরীক্ষা নিতেও বেগ পোহাতে হয়েছে। মহামারীর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বারবার স্থগিত করে আবার শুরু করতে হয়েছে। লিখিত পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবিও ছিল এ বিসিএসে। সব মিলিয়ে এই বিসিএস ঐতিহাসিক তকমা পেয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে।
পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেছেন, ‘৪০তম বিসিএসের কর্মকর্তাদের ওপর সব সময়ই স্পটলাইট থাকবে। তাদের প্রমাণ করতে হবে প্রথম মেধাভিত্তিক বাছাইয়ের কারণে তারা অনন্য।’
গতকাল বুধবার ৪০তম বিসিএসে ১ হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে ফলাফল পিএসসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে প্রশাসন ক্যাডারে ২৪৫, পুলিশে ৭২, পররাষ্ট্রে ২৫, কৃষিতে ২৫০, শুল্ক ও আবগারিতে ৭২, সহকারী সার্জন ১১২ ও পশুসম্পদে ১২৭ জন।
এ ছাড়া লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিন্তু ক্যাডার পদে সুপারিশ করা সম্ভব হয়নি এমন ৮ হাজার ১৬৬ জন প্রার্থীর রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে পদপ্রাপ্তি সাপেক্ষ নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে।
এই বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারের ২ হাজার ২১৯টি পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও ১ হাজার ৯৬৩টি জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। অবশিষ্ট পদগুলোতে কেন সুপারিশ করা হয়নি জানতে চাইলে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নূর আহমেদ বলেন, ‘কারিগারি ক্যাডারগুলোতে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া যায়নি। চিকিৎসক ও টিচার্স ট্রেনিং কলেজের জন্য পর্যাপ্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী নেই। সাধারণ ক্যাডারগুলোতে পর্যাপ্ত প্রার্থী পাওয়া গেলেও কারিগরি ক্যাডারগুলোতে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়।’
গত বছরের ২৭ জানুয়ারি ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে পিএসসি। এতে ১০ হাজার ৯৬৪ জন পাস করেন। ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি। এ বিসিএসের প্রিলিমিনারির জন্য ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন প্রার্থী আবেদন করলেও তাদের মধ্যে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৫২৫ জন পরীক্ষায় অংশ নেন। তাদের মধ্যে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হন ২০ হাজার ২৭৭ জন। আবেদনকারীর হিসাবে এটা পিএসসির ইতিহাসে রেকর্ড। কারণ এর পরের বিসিএসগুলোতেই আবেদনকারীর সংখ্যা কমেছে।
৪০তম বিসিএসের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডারের ১ হাজার ৯০৩টি শূন্যপদ পূরণের লক্ষ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত আরও ৩১৬টি পদ যোগ করে মোট ২ হাজার ২১৯টি পদে সুপারিশের জন্য বলা হয়।
এই বিসিএসের বিজ্ঞাপন জারির আগে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি বা বেতন কাঠামোর নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এর পরদিন এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর আগে এ-সংক্রান্ত সচিব কমিটিও কোটা বাতিলের সুপারিশ করে।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে নির্বাহী আদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরও কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধার নাতিদের জন্য কোটা চালু করা হয়।
বাতিলের আগে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৫ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ কোটা ছিল।
এর আগে বিভিন্ন সময় এই কোটার পরিমাণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবিতে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’। তাদের সেই আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতিই আর রাখা হবে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকার একাধিক থানায় একাধিক মামলা হয়েছিল। আন্দোলনের একপর্যায়ে ঢাকা শহরে কোনো যানবাহন চলতে দেয়নি আন্দোলনকারীরা। সাধারণ মানুষও এতে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছিল।
এই অবস্থায় সরকারি চাকরির কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে সচিব কমিটি করে সরকার। কমিটি ওই সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যদের মতামত নেয়। সরকারি কমিটি কোটা নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনা করে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে ১০টি বিসিএসের তথ্য তুলে ধরা হয়। তথ্য বিশ্লেষণ করে কমিটি দেখতে পায়, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ০৯ শতাংশ, নারী কোটায় সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তা কোটায় এক দশমিক ১৭ শতাংশ প্রার্থীকে চাকরি দিতে সুপারিশ করার নজির পাওয়া গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কোনো কোটা না রেখে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ জমা দেয় সচিব কমিটি।
৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নেও দেরি হয়েছে। একজন পরীক্ষক খাতা মূল্যায়ন করার পর তার মূল্যায়ন সঠিক হয়েছে কি না, সেটি যাচাইয়ের জন্য ওই খাতা দ্বিতীয় ধাপে একজন নিরীক্ষক পুনরায় পরীক্ষা করেন। পুনঃনিরীক্ষণ করার সময় নিরীক্ষক দেখেন, যেখানে যেমন নম্বর দেওয়ার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়েছে কি না। আবার নম্বর যোগ করতে কোথাও ভুল হয়েছে কি না। এই প্রক্রিয়া শেষ হলে তবেই ফলাফল চূড়ান্ত করা হয়। তৃতীয় পরীক্ষকের থেকে মূল্যায়নপত্র আসতে দেরি হওয়ায় ফল প্রকাশে বিলম্ব হয়েছে।
এই বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নের দাবিও উঠেছিল। একদল অনুত্তীর্ণ পরীক্ষার্থী এমন দাবি তুলেছিলেন। এ দাবিতে তারা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তারা প্রায় এক হাজার পরীক্ষার্থী খাতা পুনর্মূল্যায়নের পক্ষে কথা বলেছিলেন। তাদের মূল দাবি ছিল তারা আগের বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে নন-ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ পেয়েছেন। অথচ ৪০তমে এসে তারা লিখিত পরীক্ষাতেই উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তাদের দাবি আমলে না নিলেও এতে সময় ক্ষেপণ হয়েছিল পিএসসির।