ডেস্ক নিউজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন দিনের সরকারি সফরে আগামী সোমবার ভারত যাচ্ছেন। সফরকালে দুই প্রধানমন্ত্রী তাদের বৈঠকে যোগাযোগ, বাণিজ্য, পানি বণ্টন থেকে শুরু করে দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, তিস্তার অমীমাংসিত ইস্যু এবং বিবিআইএন উদ্যোগ দুই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার সময় টেবিলে উঠতে পারে। উত্তর-পূর্ব ভারতের কৌশলগত অবস্থানের কারণে ‘বিবিআইএন করিডর’ গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতে থাকবেন এবং নয়াদিল্লি থেকে তিনি আজমিরের খাজা গরীব নওয়াজ দরগাহ শরীফেও যাবেন। বেশ কিছু কারণে শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর তাৎপর্যপূর্ণ। শেষবার তিনি ভারত সফর করেছিলেন ২০১৯ সালে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যতবারই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন, ততবারই জনগণের মধ্যে আশা জাগে দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধানে যথেষ্ট অগ্রগতি হবে। এবং এও ঠিক, তার নেতৃত্বে দুই দেশের মধ্যে কানেক্টিভিটিসহ নানা বিষয়ে সম্পর্কের অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু ভারত এখনো নেপাল এবং ভুটানকে চট্টগ্রাম ও মোংলায় বন্দর সুবিধা ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রানজিট সেবা দেয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আজো হয়নি। বাংলাদেশ বহু বছর ধরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছে এবং ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন, তখন দুই দেশ একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়ার পথে ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে শেষ মুহূর্তে সবকিছু ভেস্তে যায়। এমনকি ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও স্পষ্ট প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন সমস্যাটি সমাধান করা হবে। কিন্তু এতদিনেও তেমন কিছুই হয়নি।
এরকম প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা তার আসন্ন নয়াদিল্লি সফরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এর ফলে এটা স্পষ্ট, তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে হাসিনা-মমতার মধ্যে আলোচনা হতে পারে। এছাড়াও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিয়েও শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হতে পারে। এই বিষয়গুলোর প্রত্যেকটি অন্যটির সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত। তবে এও ঠিক
রোহিঙ্গা ইস্যুটি অমীমাংসিত থাকা অবস্থায় কোনো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা কীভাবে সম্ভব তা স্পষ্ট নয়। যখন রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের কথা আসে তখন ভারত সবসময়ই দ্বিধা-দ্বন্দের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানায়। ভারত, চীন এবং রাশিয়া- সবাই মিয়ানমারের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ এই সব দেশই শুধু বাংলাদেশ নয়, এর নাগরিকদেরও ক্ষুব্ধ করেছে। আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ শিগগিরই পুনরায় চালু হবে এবং আশা করা হচ্ছে যে আগরতলা ও চট্টগ্রাম কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আকাশপথে সংযুক্ত হবে। যদি পরিস্থিতি অনুকূল থাকে, বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে ত্রিপুরাসহ ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন হতে পারে। মূলত এসব বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের ফলাফল প্রত্যাশা করবে।
এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে সমঝোতা স্মারক সই হবে। এছাড়া এনার্জি এন্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট (টিইআরআই) তাকে ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’- এ ভূষিত করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। আর ৬ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকটি হবে। এছাড়া একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীর যেসব সৈনিক ও কর্মকর্তা শহীদ হয়েছিলেন বা গুরুতর আহত হয়েছিলেন তাদের বংশধরদের ‘মুজিব বৃত্তি’ দেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক মুন্সী ফয়েজ আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, ভারত হল আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। আমাদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্বসহ সবকিছুর অংশীদার। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ থাকলে আমাদের সবকিছুতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এজন্য দেশটির সঙ্গে সবসময় আমাদের সুসম্পর্ক দরকার। এই সুসম্পর্কের মধ্যেও টানাপড়েন দেখা দেয়। তারপরেও সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়েছে। তিনি বলেন, সবমিলিয়ে বাংলাদেশ এখন যে জায়গায় পৌঁছেছে এবং ভবিষ্যতে যে জায়গায় যেতে চায় সেখানে যেতে ভারতের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। এছাড়াও দুই দেশেরই সংসদ নির্বাচন সমাগত। তাই এই সফর দুই পক্ষেরই অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। তার এই সফর দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলেছেন, ভূরাজনীতিগত কারণে বাংলাদেশকে ‘হটস্পট’ করে তোলার পাশাপাশি ভারতের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান প্রতিবেশিতে রূপান্তরিত করেছে। যখন বড় দেশগুলো ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকাগুলোর সঙ্গে মিত্রতার ব্যবসায় ফিরে এসেছে, তখন নয়াদিল্লির কৌশলগত উচ্চাকাক্সক্ষার জন্য ঢাকার গুরুত্ব দ্রুত বাড়ছে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির মূল স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য গত কয়েক বছরে অভূতপূর্ব হারে বাড়ছে। জ্বালানি সহযোগিতায় ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড এবং পেট্রোনেট এলএনজি লিমিটেডের মতো কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাজ করছে।
নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে তার ভৌগোলিকভাবে অনগ্রসর উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসাবে দেখে। গত জুলাই মাসে ভারতের আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্ত বিশ্বশর্মা বাংলাদেশি এক প্রতিনিধি দলকে গুয়াহাটিতে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তার কারণে আসামের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারছে।
তবে বিশ্লেষকরা এও বলছেন, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আরো মজবুত হলে তা ভারতের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তা সত্ত্বেও এই ধরনের পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ভারত ও চীন উভয়ের সঙ্গেই ঢাকা ভারাসাম্য সম্পর্ক রেখেছে। তবু নীতিনির্ধারকরা বিশ্বাস করেন, নয়াদিল্লি যদি ঢাকার সঙ্গে তার ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়- দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। কারণ নয়াদিল্লির প্রতিশ্রæত ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি নিয়ে ঢাকা মাঝে মাঝে দ্বিধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে, এই অঞ্চলে চীনা প্রভাব মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক ইত্যাদির মতো বেশ কয়েকটি উদ্যোগে ভারত যোগ দিয়েছে। সবমিলিয়ে সর্বোচ্চ স্বার্থের কারণেই ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা বজায় রাখা প্রয়োজন।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর সামনা-সামনি আলোচনায় বহু বিষয় উঠে আসবে। এতে বিদ্যমান সুসম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে। তবে এও ঠিক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের নিরাপত্তা ঝুঁকি নির্মূল করেছেন। কিন্তু তিস্তা চুক্তি এখনো হয়নি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনলেও আরো কমালে ভারতের তেমন ক্ষতি হবে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে আমরা আশা করব, রোহিঙ্গাদের থাকার জায়গা দিয়ে শেখ হাসিনা মানবতার নজির তৈরি করেছেন। এখন ভারত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কাজ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাহায্য করবে। শুধু সাহায্যই নয়, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘসহ বড় দেশগুলোকে নিয়ে ভারত কাজ করবে।
জানা গেছে, আগরতলা-আখাউড়া রেললাইনের চলমান কাজ আগামী বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। আগরতলা (ত্রিপুরা)-আখাউড়া (বাংলাদেশ) রেলপথটি বাংলাদেশের গঙ্গাসাগর থেকে ভারতের নিশ্চিন্তপুর (১০.৬ কিলোমিটার) পর্যন্ত এবং তারপর নিশ্চিন্তপুর থেকে ভারতের আগরতলা রেলওয়ে স্টেশন (৫.৪৬ কিলোমিটার) পর্যন্ত চলবে। এই পথ চালু হলে গুয়াহাটি বাইপাস করে এবং ঢাকার মাধ্যমে কলকাতা ভ্রমণ করা যাবে। নতুন ট্রেন রুট ভ্রমণের সময় ৩১ ঘণ্টা থেকে ১০ ঘণ্টা কমিয়ে দেবে এবং দূরত্ব ১৬০০ কিলোমিটার থেকে ৫৫০ কিলোমিটারে নেমে আসবে। রেল সংযোগটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার প্রসারিত করবে, পণ্য পরিবহনের উন্নতি ঘটাবে এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া আগরতলা-ঢাকা এবং আগরতলা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-গুয়াহাটি আন্তর্জাতিক রুটে বিমান পরিষেবা এই বছরের মধ্যে শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা নিশ্চিতভাবে জনগণের মধ্যে যোগাযোগ এবং পর্যটন খাতকে আরো শক্তিশালী করবে। সবমিলিয়ে ভারত ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ নেয়ায় দুই দেশের মধ্যে সংযোগ বহুমুখী হারে বাড়ছে।