ডেস্ক নিউজ
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) গবেষণা বলছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ তুলনামূলক কম। এ খরচ এশিয়ার দেশ ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়েও কম। সম্প্রতি প্রকাশিত এডিবির ‘হারনেসিং ডিজিটালাইজেশন ফর রেমিট্যান্সেস এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক গবেষণায় এমন তথ্য দেয়া হয়েছে।
রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রতি ২০০ ডলার রেমিট্যান্স পাঠাতে ভারতের একজন প্রবাসীর খরচ হয় প্রায় ১২ ডলার। অপরদিকে নেপালের বেলায় প্রায় ৯ ডলার, শ্রীলঙ্কায় আট ডলার, তাজিকিস্তান আট ডলার, পাকিস্তানে প্রায় আট ডলার। সেখানে বাংলাদেশে একজন প্রবাসীর খরচ হয় প্রায় তিন শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ২০০ ডলার দেশে পাঠাতে খরচ হয় ছয় ডলার। অপরদিকে কাজাখস্থান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান ও জর্জিয়ার দেশগুলোতে এক শতাংশেরও কম খরচ হয় প্রতি ২০০ ডলার পাঠাতে।
রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ সম্পর্কে বলা হয়, মহাদেশ ও মুদ্রাভেদে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ বাড়ে-কমে। আবার যেসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর বেলায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে-তারা অপেক্ষাকৃত কম খরচে পাঠাতে পারছে। এর ফলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আদান-প্রদানের পরিমাণও বাড়ছে।
গবেষণায় বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, প্রবাসীদের খরচ কমিয়ে দিতে বাংলাদেশ সরকার রেমিট্যান্সের ওপর দিকেই বেশি আকৃষ্ট হয়েছিল ব্যাংক। আবার এসব ঋণ থেকে আদায়ের হারও অন্য সব ঋণ থেকে বেশি ছিল। কারণ এসব ঋণের বড় একটি অংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদেরকেই এসব ঋণ বেশি দেয়া হতো। মাস শেষে বেতন থেকে তা পরিশোধ করতেন গ্রাহক; কিন্তু সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গত বছরে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ভোক্তাঋণে বেকায়দায় পড়ে গেছে ব্যাংকগুলো।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে মানুষের আয় কমে গেছে। অনেকেই ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে ঠিকানা বদল করেছেন। তাই জামানতবিহীন এসব ঋণ আদায় করা ব্যাংকের জন্য অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এতে ব্যাংকের সামগ্রিকভাবে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো থেকে শিল্পের মেয়াদি ও চলতি ঋণের পাশাপাশি ভোক্তাঋণ বিতরণ করা হয়। ব্যাংকের আয়ের বড় ধরনের অবদান রাখে ব্যক্তিপর্যায়ের ভোক্তাঋণ, ক্রেডিট কার্ডের ঋণসহ জামানতবিহীন ঋণ। জামানতবিহীন ঋণ হওয়ায় এসব ঋণে ঝুঁকিও বেশি। আর ঝুঁকি বেশি হওয়ায় এসব ঋণগ্রহীতাকে বাড়তি সুদ বা মুনাফা পরিশোধ করতে হয়। এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় ক্রেডিট কার্ডের ঋণ সিঙ্গেল ডিজিট অর্থাৎ ৯ শতাংশের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ভোক্তাঋণ বাদে সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ভোক্তাঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০ শতাংশের বেশি সুদ আদায় করা যাবে না ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে।
ব্যাংকারা জানিয়েছেন, এসব ঋণের তেমন কোনো জামানত নেয়া হয় না। যেমন, কেউ কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলে তার বেতনের বিপরীতে এ ঋণ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শুধু বেতনের তথ্যাদি জমা দিতে হতো। এর ওপর ভিত্তি করে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনায় নেয়া হতো সংশ্লিøষ্ট গ্রাহকের; কিন্তু গত বছরের মার্চ থেকে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সব হিসাব এলোমেলো হয়ে পড়ে। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। আনেক প্রতিষ্ঠানের বেতনভাতা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে যারা নিয়মিত বেতনভাতা পেয়ে সংসারের প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি অর্থ দিয়ে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করতেন তারা পড়ে যান বিপাকে। বেতনভাতা না পেয়ে সংসারের প্রয়োজন মেটাতে পারছেন না অনেকেই। আবার কেউ কেউ বাড়িভাড়া পরিশোধ না করে রাজধানী ঢাকা ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন। এর ফলে ইতোমধ্যে যেসব জামানতবিহীন ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ওই সব ঋণ ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে। বেশির ভাগ জামানতবিহীন ঋণই এখন আদায় হচ্ছে না। এতে এক দিকে ব্যাংকের আয় যেমন কমে গেছে, তেমনি এসব ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ভোক্তাঋণ এখন ব্যাংকের গলার কাঁটা হয়ে গেছে। আগে যেসব ঋণগ্রহীতারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন আয় কমে যাওয়ায় এখন তারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আবার অনেকেই ঠিকানা বদল করেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতাকে পাাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এমনি পরিস্থিতিতে সবচেয়ে লাভবান খাত ভোক্তাঋণ দিতে অনেকটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন ব্যাংকাররা। গতকাল বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, এ মুহূর্তে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে ঝুঁকির মাত্রা বাড়াতে চাচ্ছেন না। একসময় ভোক্তাঋণের প্রতি বেশি ঝোঁক ছিল ব্যাংকের। করোনার কারণে সব হিসাব পাল্টে গেছে। এখন জামানতবিহীন ঋণ দিয়ে কেউ ঝুঁকির মাত্রা বাড়াতে চাচ্ছেন না। অনেকটা নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ছে ব্যাংকগুলো। এ মুহূর্তে নিরাপদ বিনিয়োগ কোন খাত এমন এক প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, প্রণোদান প্যাকেজ অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে না। কারণ এই মুহূর্তে ঋণ নিয়ে কোনা প্রজেক্টই লাভবান হবে না। এ কারণে যারা ঋণ নেবেন তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না। এ কারণে ব্যাংকগুলো সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে। এতে বছর শেষে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই আয় কমে যাবে। তবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আর মানুষের আয় বাড়লে আবারো বেসরকারি খাতে ঋণ দিতে উৎসাহী হবে ব্যাংকগুলো।