বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ মারা গেছেন। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর বসুন্ধরার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। স্যার ফজলে হাসানের হাতে গড়া ব্র্যাক আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সম্মানিত এনজিও। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র বিমোচনে কাজ করে এটি।
সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকার জন্য তিনি র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার মাহবুবুল হক পুরস্কার, গেটস ফাউন্ডেশনের বিশ্ব স্বাস্থ্য পুরস্কার এবং শিক্ষাক্ষেত্রের ‘নোবেল’ বলে খ্যাত ইয়াইদান পুরস্কার লাভ করেন। দারিদ্র্য বিমোচন এবং দরিদ্রের ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘নাইটহুড’এ ভূষিত করে।
১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফজলে হাসান আবেদ। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে দেশভাগের ঠিক আগে তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি চাচার চাকুরিস্থলে কুমিল্লা জেলা স্কুলে ভর্তি হন। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনিও চাচার সঙ্গে পাবনায় চলে যান এবং পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হোন। সেখান থেকেই ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৪ সালে এইচএসসি পাস করেন নটরডেম কলেজ থেকে। সেবছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।
১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে স্কটল্যান্ডে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। নেভাল আর্কিটেকচারের কোর্স ছিল চার বছরের। দুবছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। সেখানে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের ওপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্সে পাস করেন ১৯৬২ সালে। এ ছাড়া তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইনস ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব ল’ এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব এডুকেশন’ ডিগ্রি লাভ করেন।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়াকালীন ১৯৫৮ সালে ফজলে হাসান আবেদের মায়ের মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে তিনি লন্ডনে চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর চলে যান কানাডা। সেখানেও একটি চাকরিতে যোগ দেন। পরে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
১৯৬৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে তিনি শেল অয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স পদে যোগদান করেন। এখানে চাকরির সময় সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। ফজলে হাসান আবেদ উপদ্রুত এলাকা মনপুরায় গিয়ে ত্রাণকাজ পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন ফজলে হাসান আবেদ।
ব্র্যাকের জন্ম হয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
সিলেটের শাল্লায় যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি জনপদের মানুষজনের জন্য ত্রাণ সহায়তা দিতে কাজ শুরু করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তিনি তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে ত্রাণকাজ শুরু করেন।সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিটি বা ব্র্যাকের।
তবে ১৯৭৩ সালে যখন পুরোদস্তুর উন্নয়ন সংস্থা হিসাবে ব্র্যাক কার্যক্রম শুরু করে, তখন তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি।’ তবে সংক্ষিপ্ত নাম ব্র্যাকই থাকে।
রীতিমত বর্ণিল কর্মজীবন ছিল স্যার ফজলে হাসান আবেদের। তার প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক ক্রমে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থায় পরিণত হয়।
ক্ষুদ্র ঋণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন এবং বাল্যবিবাহ রোধসহ সহ নানা খাতে কাজ করেছেন তিনি।
বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় তেরো কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নে নিরলস কাজ কাজ করে যাচ্ছে। সামাজিক ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্যার আবেদ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বিশ্ব জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান এবং বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ফজলে হাসান আবেদ ২০১৬ সালে ‘টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ’ পদক লাভ করেন। খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি হাঙ্গেরির ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি’ (সিইইউ) থেকে ‘ওপেন সোসাইটি প্রাইজ’ লাভ করেন।
২০১১ সালে তিনি কাতার ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ওয়াইজ প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১০ সালে দারিদ্র্য-বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্যের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি ‘নাইটহুড’ লাভ করেন। এছাড়া ২০০৭ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ এবং ২০০৮ সালে মানবিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ব্র্যাক বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিট্যারিয়ান অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করেন। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার রয়েছে তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে। অশোকা ফজলে হাসান আবেদকে অন্যতম ‘গ্লোবাল গ্রেট’ স্বীকৃতিতে ভূষিত করেছে।
২০১০ সালে জাতিসংঘের মহাপরিচালক বান কি মুন ফজলে হাসান আবেদকে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ‘স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গে’র একজন হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। পুরস্কার ও সম্মানের পাশাপাশি একাধিক বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডিগ্রি অর্জন করেন।
এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব লজ’,
২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর ইন এডুকেশন’,
২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টরেট অব হিউম্যান লেটার্স’,
২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব লজ’,
২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব লেটার্স’ উল্লেখযোগ্য।