ডেস্ক নিউজ
ঢাকাই মসলিন শুধু একটি নাম নয়, একটি কিংবদন্তির ইতিহাস। এটি ঐতিহ্য ও রাজসিক আভিজাত্যের সাক্ষী। মসলিন শব্দটির সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। হাজার বছরের এই ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে তাও প্রায় ২০০ বছর আগে। সেই হারিয়ে যাওয়া ঢাকায় মসলিনের পুনর্জাগরণ ঘটছে বাংলাদেশে। সন্ধান মিলেছে ফুটি কার্পাস তুলার, তৈরি হচ্ছে মসলিন সুতা এবং সুতা থেকে ৬টি শাড়ি, ৬টি ওড়না ও গজ কাপড়। অনেক অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে মসলিন বুননের দক্ষ কারিগর। গত ছয় বছর ধরে এক দল গবেষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঢাকাই মসলিন নিয়ে পেয়েছেন বড় সাফল্য। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মধ্যেই মসলিন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়া হবে।
অন্যদিকে ঢাকাই মসলিনের মালিকানা এখন শুধুই বাংলাদেশের। ঢাকাই মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে গত ১০ ডিসেম্বর। সে দিন থেকে দুই মাস পর্যন্ত অর্থাৎ গত ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনো দেশ বা পক্ষের তরফ থেকে আপত্তি জানানো বা মালিকানা দাবি করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে কোনো পক্ষ থেকে আপত্তি না আসায় ঢাকাই মসলিনের মালিকানা দাবি করতে পারবে কেবল বাংলাদেশ।
পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, মসলিনসহ আরও ৫ পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ২৬ এপ্রিল বিশ^ মেধাস্বত্ব দিবসে বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকাই মসলিসনসহ মোট ৬ পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে তাঁত বোর্ড ট্রেডমার্ক অধিদফতরে আবেদন করেছে সার্টিফিকেটের জন্য। সার্টিফিকেট হাতে পেলেই ‘ঢাকাই মসলিন’ আনুষ্ঠানিকভাবে শুধুই বাংলাদেশের হয়ে যাবে।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মসলিন পুনরুদ্ধারে বিষয়টি সামনে আসে মূলত ২০১৪ সালে। ওই বছরের ১২ অক্টোবর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকাই মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারের নির্দেশনা দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ আলীমুজ্জামান, বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান, বিটিএমসি ঢাকার মহাব্যবস্থাপক মাহবুব-উল আলম, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের উপমহাব্যবস্থাপক এএসএম গোলাম মোস্তফা ও সদস্য সচিব করা হয় তাঁত বোর্ডের জ্যেষ্ঠ ইনস্ট্রাক্টর মো. মঞ্জুরুল ইসলামকে। পরে গবেষণা কাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে এই কমিটিতে যুক্ত করা হয়। তারা হলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুলবন ওসমান, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এম ফিরোজ আলম, অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিল বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান, তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলী ও রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রাজশাহীর গবেষণা কর্মকর্তা মো. আবদুল আলিম।
২০১৮ সালে নেওয়া হয় মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধারে নতুন প্রকল্প। মসলিনকে ফিরে পেতে তাঁত বোর্ডের নেওয়া এই প্রকল্পের খরচ অবশ্য খুব বেশি নয় মাত্র ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা। এটি মূলত একটি বিনিয়োগ বা গবেষণা প্রকল্প। এতে মসলিনের প্রযুক্তি উদ্ধার করা হবে। পুরো প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চলতি বছর বা ২০২১ সালের জুনের মধ্যে শেষ হবে। এ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক করা হয়েছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলীকে।
সময়ের আলোকে মো. আইয়ুব আলী বলেন, ঢাকাই মসলিন পুনরুদ্ধারে যে ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় তার মধ্যে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা খরচেই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। ১০ কোটি টাকাই বেঁচে যায়। আমরা সে টাকা সরকারকে ফেরত দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, ওই অর্থ দিয়ে মসলিন নিয়ে গবেষণা ও পাইলট প্রকল্পের কাজে ব্যয় করতে। সরকারের নির্দেশনা মতো আমরা মসলিন নিয়ে সংশোধিত প্রকল্প গ্রহণ করেছি এবং এটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হয়ে এলে আগামী অর্থবছর থেকে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হবে। আগামী বছর থেকে ১০০ জন দক্ষ সুতা মসলিন সুতা তৈরির কারিগর গড়ে তোলা, মসলিন কাপড় উৎপাদন ও ফুটি কার্পাস তুলা চাষের জন্য এক একর জমি ক্রয় করা হবে।
মসলিন নিয়ে গবেষণা এবং এখন পর্যন্ত কী কী সাফল্য এসেছে তার গল্প শোনালেন বিশেষজ্ঞ কমিটির অন্যতম সদস্য রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, মসলিন পুনরুদ্ধার কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মসলিন সম্পর্কে নতুন করে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। কাজ করতে গিয়ে আমরা আবেগাপ্লুত হয়েছি, কারণ মসলিন শব্দটি আমাদের কাছে অনেক আবেগের। এটি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ।
তিনি বলেন, মসলিন পুনরুদ্ধারে আমাদের অন্ধকারে হাতড়ানোর মতো অবস্থায় নামতে হয়েছিল। কারণ ইতিহাস থেকে পাওয়া কিছু তথ্য ছাড়া আর তেমন কিছুই ছিল না আমাদের সামনে। সবচেয়ে কঠিন কাজটি ছিল মসলিনের সুতা তৈরি হয় যে তুলা থেকে সেই ‘ফুটি কার্পাস’ তুলার সন্ধান পাওয়া। সারা দেশ তন্নতন্ন করে খুঁজে আমরা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ফুটি কার্পাসের সন্ধান পাই। সেখানেই ১৫ কাঠা জমির ওপর চাষ শুরু করি ফুটি কার্পাসের। ইতোমধ্যে ৪০ শতাংশ তুলা উত্তোলন সম্পন্ন হয়েছে। এই তুলা দিয়ে দক্ষ কারিগরের মাধ্যমে মসলিন কাপড় তৈরির সুতা বানানো হয়েছে। সাধারণত ৩০০ কাউন্ট পর্যন্ত সুতাকে মসলিন বলা হয়। আমরা এখন পর্যন্ত ৩০০, ৩৫০ এবং সর্বোচ্চ ৫৫৭ কাউন্ট পর্যন্ত সুতা উৎপন্ন করতে পেরেছি।
মুঘল আমলে ৬০০ কাউন্ট সুতাকে বলা হতো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের মসলিন। আমরা এখন সেই মধ্য যুগের মসলিনের একেবারে কাছাকাছি চলে গেছি-এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে মসলিন পুনরুদ্ধারে সবচেয়ে বড় সাফল্য।
অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, মসলিন পুনরুদ্ধারে আরেক বড় সাফল্য হচ্ছে একেবারে হুবহু আদি ঢাকাই মসলিনের মতো মোট ১২টি ঢাকাই মসলিন পণ্য তৈরি করতে পেরেছি। এর মধ্যে ৩০০ কাউন্ট সুতার ৬টি মসলিন শাড়ি, ৫০০ কাউন্টের ৬টি ওড়না এবং বেশ কিছু গজ কাপড়। ৩০০ কাউন্ট সুতার প্রথম যে শাড়িটি বানানো হয়েছিল সেটি তৈরিতেই ২ বছর লেগে গিয়েছিল। কারণ সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে এই সূক্ষ্ম সুতায় মসলিন শাড়ির বুনন। শেষ পর্যন্ত আমরা সফল হয়েছি। আমরা এখন আরও সামনে এগোতে চাই। আরও বেশি করে ফুটি কার্পাসের চাষ করা হবে। তুলা ও সুতার উৎপাদন বাড়ানো হবে। কীভাবে আদি ঢাকাই মসলিনের পুরো আবহ ফিরিয়ে আনা যায় আমরা সে চেষ্টা করব।
অন্যদিকে প্রকল্প পরিচালক আইয়ুব আলি বলেন, একটি মসলিন শাড়ি বানাতে কমপক্ষে ৩ থেকে ১০ মাস সময় লাগে। খরচ পড়ে ১ থেকে ৩ লাখ টাকা। বর্তমানে মসলিন শাড়ি বিক্রয় না হলেও, কাজ করে যাচ্ছে তাঁত বোর্ড। একটি শাড়ি বানাতে তাঁতির খরচ হয় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। আর সুতোর খরচ প্রায় দেড় লাখ টাকা। অন্যদিকে একটি ৫ হাত মসলিন ওড়না ডিজাইনসহ বানাতে খরচ পড়ে প্রায় ৫৪ হাজার টাকা। আর ডিজাইন ছাড়া ১২ হাত ওড়না বানাতে খরচ প্রায় ৭০ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে মসলিন শাড়ি বানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একটি উপহারও দেওয়া হয়েছে।
ফুটি কার্পাসের সন্ধান মেলে যেভাবে : মসলিন পুনরুদ্ধারে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ফুটি কার্পাসের সন্ধান পাওয়া। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিটিভিতে প্রচার করা হয়। একদিন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এটা দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকার একটি কলেজের অধ্যক্ষ মো. তাজউদ্দিন ফুটি কার্পাসের সন্ধান চেয়ে স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজে প্রচারপত্র বিলি করেন এবং মাইকিং করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। গবেষকরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু; বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে নেওয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কাণ্ড ও ফুল। গবেষকরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান। সম্ভাব্য ফুটি কার্পাসের এই জাত রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের নিজস্ব মাঠে ও আইবিএসসির মাঠে পরীক্ষামূলক চাষ করা হয়।
লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করা হয়। গবেষকরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহীত কাপাসিয়ার একটি জাতের ফুটি কার্পাস গাছের মিল পান। তারা নিশ্চিত হন, সেটিই তাদের কাক্সিক্ষত জাতের ‘ফুটি কার্পাস’।
স্থানীয় আবদুল আজিজ নামের এক ব্যক্তি এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেওয়া হয়।
যেভাবে মিলল কারিগরের সন্ধান : তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, মসলিন তৈরি করার জন্য সাধারণত ৩০০ থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা সহজ নয়। এমনকি এ সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় পাওয়া যায়। কিন্তু তারা মোটা সুতা কাটেন, যাতে কাউন্টের মাপ আসে না। পরে তাদের ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখান থেকে ছয়জনকে বাছাই করা হয়। বাছাই করতেই প্রায় দুই বছর লেগে যায়। তা ছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দুজন তাঁতির খোঁজ মেলে। কিন্তু এত মিহি সুতা দিয়ে কেউ বানাতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে তাদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু কষ্টে তারা বুনন পদ্ধতি রপ্ত করেন। অবশেষে ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়, যার একটি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দেওয়া হয়েছে।
সুতার কাউন্টের হিসাব : এক কিলোমিটার সুতাকে ওজন করলে যত গ্রাম হয়, তা দিয়ে সুতার দৈর্ঘ্যকে ভাগ করলে কাউন্ট পাওয়া যায়। যেমন ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি সুতার ওজন যদি ২ গ্রাম হয়, তাহলে ২ দিয়ে ১০০০ মিটারকে ভাগ করলে ভাগফল হয় ৫০০। এই ভাগফলকেই কাউন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণত ৫০০ কাউন্ট সুতা দিয়ে মসলিন কাপড় বোনা হতো। একটি শাড়িতে ১৪০ থেকে ১৫০ গ্রাম সুতার প্রয়োজন পড়ে। এই প্রকল্পের প্রশিক্ষিত সুতা কাটুনিরা এখন পাঁচ দিনে এক গ্রাম সুতা কাটতে পারেন।
ইতিহাসে মসলিন : মুঘল আমলে তৈরি করা ঢাকাই মসলিন ঘাসের ওপর রাখলে এবং তার ওপর শিশির পড়লে কাপড় দেখাই যেত না। কয়েক গজ মসলিন কাপড় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যেত বলে জনসাধারণ একে ‘হাওয়ার কাপড়’ বলত। এমনকি একটি আংটির ভেতর দিয়ে এক থান কাপড় অনায়াসে টেনে বের করা যেত। মসলিন হতো কাচের মতো স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক তৈরিতে ব্যবহার করা হতো। মসলিন প্রায় ২৮ রকম হতো যার মধ্যে জামদানি এখনও ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এশিয়া ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন ব্যবসা কেন্দ্র লন্ডন, প্যারিস ও আমস্টারডামে ঢাকাই মসলিন একচেটিয়া অধিকার বিস্তারে সমর্থ হয়। এমনকি আরব বণিকদের মারফত উত্তর আফ্রিকাতেও তা প্রভাব বিস্তার করে। ১৮৫১ সালে লন্ডনের বিশাল প্রদর্শনীতে ঢাকাই মসলিন বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছিল। জেমস টেলরের লেখায় জানা যায়, ১৭৮৭ সালে ঢাকা থেকে যে পরিমাণ মসলিন ইংল্যান্ডে রফতানি করা হয়েছিল, তার মূল্য ছিল ৩০ লাখ টাকা। ১৮১৭ সালে এই রফতানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
মসলিন নামকরণ : ধারণা করা হয়, ইরাকের ব্যবসাকেন্দ্র মসুল থেকে ‘মসলিন’ শব্দটি এসেছে। মসুলের সূক্ষ্ম কাপড়কে ইউরোপীয় বণিকরা বলতেন ‘মসুলি’। সেখান থেকে ‘মসুলিন’, ‘মসলিন’। পরে ঢাকার আরও সূক্ষ্ম কাপড়ও হয়ে যায় মসলিন। বাংলার সবচেয়ে সূক্ষ্ম কাপড়কে ‘মলবুল খাস’ বা ‘মলমল খাস’ বলা হতো। ধারণা করা হয়, এটিই মসলিন। চৌদ্দ শতকে ইবনে বতুতা, পনেরো শতকে চীনা লেখকরাও লিখে গেছেন এর কথা। মধ্যপ্রাচ্যের অটোমান সাম্রাজ্য, মুঘল সাম্রাজ্য আর ভারতীয় রাজপরিবারে এর কদর ছিল ভীষণ। ফরাসি সম্রাজ্ঞী জোসেফিনের কাছেই ছিল প্রায় শ খানেক মসলিন। তবে ঢাকাই মসলিন নামটি প্রথম সামনে আনেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আব্দুল করিম। ১৯৬৫ সালে রচিত তার গ্রন্থ ‘ঢাকাই মসলিন’-এ তিনি মসলিনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।