ডঃ আতিউর রহমানঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘কারাগারের রোজনামচা’ লিখতে শুরু করেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৬ সালের ২ জুন তা শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১৯৬৭ সালের ২২ জুন। এর আগের কারাজীবনের কথা কারাগারের রোজনামচায় নেই। সেসব কথা আছে কিছু ইতিহাসের বইয়ে আর গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে। তবে কারা ব্যবস্থার অমানবিকতা ও অন্যায্যতা নিয়ে এ বইতে দারুণ কিছু বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন। জেল ব্যবস্থার এই কালো দিকের ওপর আলো ফেলে তিনি অনেকের চোখ খুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। তার জেলজীবন ও সংসারজীবন ছিল গায়ে গায়ে লাগানো। একটি ছেড়ে আরেকটিতে তিনি আনায়াসে ঢুকে পড়েছেন। তবে জেলজীবনের একাকিত্ব তাকে কষ্ট দিয়েছে। সেসব কথা বুকে চেপে রেখেছেন। পরিবারের সদস্যদের জানতে দেননি। মাঝে মাঝে মানিক মিয়া ও সোহরাওয়ার্দীকে এসব কষ্টের কথা খানিকটা জানিয়েছেন। এই বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জানিয়েছেন কারাজীবনের এত কষ্টের কথা তিনি তাদের জানতেই দেননি। জনগণের জন্য এমন কষ্ট স্বীকার একমাত্র বড় মাপের নেতার পক্ষেই সম্ভব।
এই পর্বে তিনি যখন জেলে বন্দি কেমন ছিল তার সংসারজীবন? তার নিজের পরিবার তখন ঢাকায়, বাবা-মা গ্রামে। চিঠিপত্রের মাধ্যমেই ভেতর-বাইরের যোগাযোগ। মাঝে মাঝে পরিবারের লোকজন জেলখানায় দেখতে আসেন তাকে। তার জীবনসঙ্গিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছার কথা আমরা আগের একটি পর্বে বলেছি।
১০ নভেম্বর, ১৯৫৮ সালের প্রতিবেদনটি থেকেও জানা যায়, বেগম ফজিলাতুন্নেছা কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়েছেন। আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন নিজের চার ছেলেমেয়ের নাম। শেখ রাসেলের তখনো জন্ম হয়নি। যে রাসেল বঙ্গবন্ধুর কারাগারকে বলেছিলেন, ‘আব্বার বাড়ি’। জন্মের পর হাঁটতে শেখা পর্যন্ত, কথা শেখা পর্যন্ত রাসেল তার পিতাকে সব সময় জেলেই দেখেছেন। যেমনটা দেখেছেন শেখ হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রেহানাও। খুব ছোটবেলায় শেখ কামালও জানতেন না যে শেখ মুজিব তারও পিতা। শিশুকালে যে তিনি তাকে কাছেই পাননি। শেখ হাসিনার এক লেখায় আছে, ১৯৫১-৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন এক জেল থেকে অন্য জেলে বদলি করা হচ্ছিল তখন ফরিদপুর জেলে একবার শেখ হাসিনা আর শেখ কামাল দেখতে গেছেন বাবাকে। শেখ হাসিনা যখন বাবাকে ‘আব্বা আব্বা’ ডাকছিলেন তখন ছোট্ট কামাল বললেন, ‘হাসু বু, তোমার আব্বাকে আমি একবার আব্বা ডাকি।‘ সে কি মর্মান্তিক এক শিশুর আকুতি!
কারাগারের রোজনামচায় শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন সেই অসহ বন্দিজীবনের কথা। এক জায়গায় লিখেছেন, ‘প্রায় এক ঘণ্টা রেনু এবং আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছিলাম। সংসারের ছোটখাটো আলাপ। ওদের বলেছি, আর কোনো কষ্ট নেই; একাকী সঙ্গীবিহীন আছি। মানিক ভাইকে বলতে বললাম, তিনি যেন চিফ সেক্রেটারিকে বলেন, কেন এই অত্যাচার? আমার স্ত্রী বলল, মানিক ভাইর সঙ্গে দেখা করব। সাক্ষাতের সময় শেষ হয়ে গেছে আর দেরি করা চলে না। তাই বিদায় দিলাম ওদের। রাসেলকে গাড়ির কথা বলে কামালের কাছে দিয়ে সরে এলাম।’ (কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ ২০১৭, পৃষ্ঠা-৯৪)। আরেক জায়গায় লিখেছেন, “আমার চারটা ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে এসেছে। ছেলে দুটি বাসায় ফিরেছে। মেয়ে দুটির একজন কলেজ থেকে, আর একজন স্কুল থেকে সোজা এসেছে। ছোট ছেলেটা রাস্তায় দাঁড়াইয়া থাকে কখন আমি গেটে আসব। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, মা, আব্বা, ভাইবোনদের খোঁজখবর নিলাম। মা ঢাকা আসতে চান না। এতদূর আসতে তার কষ্ট হবে- কারণ অসুস্থ। আব্বার বয়সও হয়েছে। আব্বা বাড়িতে। তারও কষ্ট হয় সবার চেয়ে বেশি। একলা আছেন। আজ অনেক কথা বললাম। সবই আমাদের সাংসারিক খবর এবং আমি কীভাবে জেলে থাকি তার বিষয়। বাচ্চারা দেখতে চায় কোথায় থাকি আমি। বললাম, ‘বড় হও, মানুষ হও দেখতে পারবা’।” (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৫০)
বাবা কারাগারে থাকার সময় তাদের ভাইবোনদের অবস্থা কেমন ছিল সে কথা লিখেছেন শেখ হাসিনা তার ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ গ্রন্থে। বুক ভেঙে যাওয়ার মতো সেই লেখাটির শিরোনাম : ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কিছু সময়’। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বহু বছর বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সাল একটানা প্রায় তিন বছর জেলে কেটেছে তার জীবন। তার পরও ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬, ১৯৭১ বারবার তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। যে বয়সে বাবার হাত ধরে ছোট্ট শেখ হাসিনার স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে মায়ের হাত ধরে দিনের পর দিন গেছেন বাবাকে দেখতে জেলখানায়। ১৯৫৪ সাল থেকে তারা ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন, বড় আশা করে তারা ঢাকায় এসেছিলেন পরিবারের সবাই একসঙ্গে থাকবেন বলে। কুটিল রাজনীতি তাদের সেই স্বপ্নকে ভেঙে খানখান করে দেয়। ৯(ক) ধারা জারি করে বিপুল ভোটে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকারকে শুধু অপসারণই করা হয়নি, কনিষ্ঠতম মন্ত্রীকে অযথাই জেলে ভরা হয়। তখন থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার পুরান ঢাকার এই রাস্তায় তাদের যাতায়াত। এক সময় মায়ের সঙ্গে ছোট ভাইবোনদের নিয়ে এ কারাগারে আসতেন বাবাকে দেখতেন। আজ এসেছেন তিনি একা! রেহানাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কী কারণে রেহানাকে ছাড়াই আসতে হলো। তাই মনটা আরও বেশি খারাপ তার। বাবা যেখানে বসতেন, হাঁটতেন সে জায়গাগুলো একা একা ঘুরে দেখছেন। এক সময় কামাল-জামাল, রাসেল আসত সঙ্গে। তার মনে পড়ে যায় আদরের কনিষ্ঠতম ভাইটির কথা। রাসেল কিছুতেই বাবাকে ছেড়ে যেতে চাইত না। চোখের পানি দিয়ে তিনি লিখছেন, ‘যখনই জেলখানায় গিয়েছি আব্বার সঙ্গে দেখা করতে, তখনই ফেরার সময় কষ্ট যেন বেড়ে যেত। তখন জামাল ছোট ছিল, আব্বাকে ছেড়ে কিছুতেই আসতে চাইত না। এর পর রেহানা যখন আসত, একই অবস্থা হতো, কিছুতেই আসতে চাইত না। আমি ও কামাল বড় ছিলাম বলে কষ্টটা বাইরে ছোটদের মতো প্রকাশ করতে পারতাম না। সবার বাবা সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যায়, দোকানে নিয়ে যায়, গল্প করে, খেলা করে আর আমরা শুধুই বঞ্চিত হয়েছি বাবার স্নেহ-আদর-ভালোবাসার সান্নিধ্য থেকে। ছোট্ট রাসেল জেলখানায় গেলে কিছুতেই আব্বাকে ফেলে বাসায় আসবে না। আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় যাবে। আব্বা তাকে বোঝাতেন যে, এটা আমার বাসা, আমি থাকি। তুমি মায়ের সঙ্গে তোমার বাসায় যাও। কিন্তু ছোট্ট রাসেল কী তা শুনত, জিদ ধরত, কান্নাকাটি করত। বাসায় এসে বারবার মাকে জিজ্ঞেস করত, আব্বা কোথায়? মা বলতেন, এই তো আমি তোমার আব্বা। আমাকে তুমি আব্বা বলে ডাকো।’ (‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’, মাওলা মাদ্রার্স, দশম মুদ্রণ-২০১৮, পৃষ্ঠা-১৩)
যখনকার কথা আমরা এখন বলছি তখন দেশে প্রথমবারের মতো সামরিক শাসন চলছে। ১১ নভেম্বর, ১৯৫৮ বেগম ফজিলাতুন্নেছা সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাওয়ার আবেদন করেছেন। আবেদনপত্রে তিনি সঙ্গে তাদের সন্তানদের নাম ও বয়স উল্লেখ করেছিলেন। তাদের চার সন্তানের বিবরণ :
১. হাসিনা ১০ বছর ১১ মাস। ২. কামাল ৮ বছর ১০ মাস। ৩. জামাল ৫ বছর ৮ মাস। ৪. রেহানা ২ বছর ১১ মাস।
১২ নভেম্বরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বেগম ফজিলাতুন্নেছা সেদিন শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য কিছু বই নিয়ে গিয়েছিলেন। বইগুলোর তালিকা সংরক্ষণ করেছিল গোয়েন্দা বিভাগ। বইগুলোর নাম :
১. সেল্ফ – রেসট্রেইন্ট সেল্ফ- ইনডালজেন্স। ২. ইন দ্য হাই ইয়েমেন। ৩. সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি। ৪. সিক্সটি ডেইস ইন আমেরিকা। ৫. মরুতীর্থ হিংলাজ। ৬. পথে প্রবাসে।
আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের পাঠাভ্যাসের কথা জানি। কারাগারে বসেও তিনি প্রচুর পড়তেন। কখনো কখনো বইয়ের ভেতর ডুবে থাকতেন। কারাগারে বসে পড়েছিলেন বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’, এমিল জোলার ‘তেরেসা রেকুইন’। কারাগারে রাজনৈতিক বই বেশি নিতে দেওয়া হতো না বলে তার ছিল গভীর অভিযোগ। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তিনি লিখেছেন, ‘আমার কতগুলো বইপত্র আই বি উইথহেল্ড করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে রিডার’স ডাইজেস্ট, টাইমস, নিউজউইক এবং ‘রাশিয়ার চিঠি’, কোনো বই-ই পড়তে দেবে না। আগেও দেয়নি। নভেল পড়তে দেয়। প্রেমের গল্প যত পারো পড়ো। একজন রাজনীতিক এগুলো পড়ে সময় নষ্ট করে কী করে! কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দেবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সবাই মহাজ্ঞানী ও গুণী!” (কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি, প্রথম প্রকাশ ২০১৭, (পৃষ্ঠা-১৬৭)। আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন, এমনকি কবিগুরুর রাশিয়ার চিঠির মতো বইও পড়তে দিতেন না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলে তাকে কুর্মিটোলায় বিশেষ কারাগারে রাখা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি তাকে এখানে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে গ্রন্থাগার ছিল না। বাইরে থেকেও বইও আনতে দেওয়া হতো না। সে কী দুঃসহ সময়। কী করে যে তিনি সেই সময়টা কাটিয়েছেন তা অকল্পনীয়। তার খানিকটা জানা যায় ‘কারাগারের রোজনামচার’ শেষাংশে।
লেখকঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক