ডেস্ক নিউজ
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আজীবন লালিত স্বপ্নের স্বাধীন দেশে পা রেখেছিলেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। উৎসবমুখর পরিবেশে লাখো মানুষ বরণ করে নিয়েছিল তাদের প্রিয় নেতাকে। এর মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেদিন বিকেলে তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ থেকে বঙ্গবন্ধু নামার পর ঐতিহাসিক স্থানে সেই সময়টিতেই শুরু হলো স্বাধীনতার স্থপতির জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা।
ক্ষণগণনার অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রতীকী বিমান অবতরণ, বিমান থেকে আলোক প্রক্ষেপণ ও তোপধ্বনি, প্রতীকী গার্ড অব অনার প্রদানকে মোহনীয়ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়।
শুক্রবার বিকেলে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনা অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে তার কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে বিজয়ের আলোকবর্তিকা তিনি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, সেই মশাল নিয়েই আমরা আগামী দিনে চলতে চাই। বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়তে চাই।’ খবর বাসস, ইউএনবি ও বিডিনিউজের।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ওই রাতেই বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর শুরু হয় বর্বর হামলা। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলেও তখনও পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিল সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষ।
চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিলে স্বাধীনতা লাভের ২৪ দিন পর নিজের স্বপ্নের স্বাধীন দেশে পা রাখেন জাতির পিতা। তখন থেকে দিনটি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে পালিত হয়ে এলেও ৪৮ বছর পর এবার আয়োজনে ভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে এসেছে ‘মুজিব শতবর্ষ’।
আমন্ত্রিত অতিথি ও নিবন্ধিত দর্শকদের জন্য দুপুরের পর থেকেই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরের অনুষ্ঠানস্থলের নির্ধারিত প্রবেশ পথগুলো। সবাইকে যেতে হয় নিরাপত্তা তল্লাশির মধ্য দিয়ে। মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ দুপুর ২টা থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে শুরু করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে এসে মঞ্চে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এবং বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও ছিলেন। প্যারেড গ্রাউন্ডে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রমুখ।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, গৃহায়ন ও পণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোহাম্মদ নাসিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, আবদুর রহমানসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন এ আয়োজনে।
এছাড়া সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিদেশি বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। দুই হাজারের বেশি আমন্ত্রিত অতিথি এবং দশ হাজারের বেশি নিবন্ধিত দর্শকের উপস্থিতিতে স্মরণ করা হয় সেই মুহূর্তটিকে।
মূল অনুষ্ঠানের শুরুতেই পুরাতন বিমানবন্দরে অবতরণ করে একটি উড়োজাহাজ। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার দুই দিন পর লন্ডন হয়ে ১০ জানুয়ারি অপরাহেপ্ত ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের ওই রকম একটি উড়োজাহাজে করেই তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দরে পৌঁছান জাতির পিতা। বিমানটি ধীরে ধীরে এসে টারমাকে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে এসে থামে। এ সময় বাজানো হয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই গান- ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় …’।
বিমানটি টারমাকে পৌঁছানোর পর দরজা খোলা হলে ২১ বার তোপধ্বনি দেওয়া হয়। পতাকা হাতে ১৫০ জন তখন সেখানে লালগালিচার পাশে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। তাদের জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান আর লেজার লাইটের মাধ্যমে বিমানের দরজায় ফুটিয়ে তোলা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে সেই আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে লালগালিচার মাথায় ছোট্ট মঞ্চে এসে থেমে যায়। এরপর গার্ড অব অনার দেয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল। বঙ্গবন্ধু যে আলোকবর্তিকা হয়ে সেদিন দেশে ফিরেছিলেন, তারই প্রতীকী উপস্থাপনা ছিল এ আয়োজন। বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার এই প্রতীকী অবতরণ দেখে কেঁদেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা।
ল্যাটপটের বোতাম চেপে প্রধানমন্ত্রী মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন ও ক্ষণগণনার উদ্বোধন করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর হাতে লোগো তুলে দেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের ২৮টি স্পটে, ৫৩ জেলায় ও দুটি উপজেলা মিলিয়ে মোট ৮৩টি জায়গায় বসানো কাউন্টডাউন ক্লকও সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে যায়।
অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে দাঁড়িয়ে ১৯৭২ সালের সেই দিনের ঘটনাপ্রবাহে ফিরে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘সেদিনটিতে আমরা হয়ত বিমানবন্দরে আসতে পারিনি, তখন আমার বাচ্চাটি ছোট ছিল, আমরা এমন অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু আমার মনে পড়ে মা সর্বক্ষণ একটি রেডিও নিয়ে বসেছিলেন, ধারাবাহিক বিবরণ শুনছিলেন, আমরা পাশে বসে সারাক্ষণ ধারাবিবরণী শুনেছিলাম।’
জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসার কথা তুলে ধরে তার জ্যেষ্ঠ কন্যা বলেন, ‘আমার মনে পড়ে, তিনি কিন্তু বাংলার মাটিতে নেমে আমাদের কথা ভাবেননি, পরিবারের কথা ভাবেননি। তিনি চলে গিয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানে তার প্রিয় জনগণের কাছে, তার প্রিয় মানুষগুলোর কাছেই তিনি সর্বপ্রথম পৌঁছে যান। তারপর আমরা তাকে পাই। তিনি এ দেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। চেয়েছিলেন এ দেশের মানুষ সুন্দর জীবন পাবে।’
এই প্রেক্ষাপটে কবিগুরুর ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ”রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি’। তারই জবাব বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন সেই ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে। জাতির পিতা বলেছিলেন, কবিগুরু দেখে যান আপনার সাত কোটি মানুষ আজ মানুষ হয়েছে, তারা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে।”
প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি, তাকে জীবন দিতে হয়েছিল বাংলার মাটিতে।’ তিনি বলেন, ‘মাঝখানে একটা কালো অধ্যায় আমাদের জীবন থেকে চলে গেছে, সেই কালো অধ্যায় যেন আর কোনো দিন আমাদের দেশের মানুষের ওপর ছায়া ফেলতে না পারে। আমাদের দেশের মানুষ যেন জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলে এই বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারে, সেই কামনা করে ক্ষণগণনার শুভ সূচনা ঘোষণা করছি।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘চলুন আজকের দিনে আমরা সেই প্রত্যয় নিই যে এই বাংলাদেশ কারও কাছে মাথানত করে না, বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে বিশ্বে চলবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন সেই সোনার বাংলা ইনশাআল্লাহ আমরা গড়ে তুলব।’
বক্তৃতার শেষপ্রান্তে এসে উপস্থিত সবাইকে নিয়ে কয়েকবার ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দেন শেখ হাসিনা। এ সময় শেখ রেহানা ও সজীব ওয়াজেদ জয়কেও ডেকে নিয়ে তিনি স্লোগানে শামিল করেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের ক্ষণগণনা শুরুর এই মুহূর্তও ‘ঐতিহাসিক ক্ষণের’ মর্যাদা পাবে বলে মনে করছেন অনেকে। সেই উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থেকে ঢাকার তেজগাঁওয়ের প্যারেড স্কয়ারে ছুটে এসেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নানা বয়সী মানুষ। এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে পেরে আনন্দ প্রকাশ করেন তারা।
গত বছরের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় মুজিববর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সরকার মুজিববর্ষ উদযাপন করবে। দেশের বাইরেও উদযাপিত হবে জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষের নানা আয়োজন।
জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানটি হবে এ বছরের ১৭ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হবে। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি ও কর্মজীবন নিয়ে হলোগ্রাফিক উপস্থাপনা ও থিম সং পরিবেশিত হবে। মূল অনুষ্ঠানের পর থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আতশবাজি।
মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, আবুধাবির যুবরাজ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ান, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী, ভারতের কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সোনিয়া গান্ধী, ওআইসি মহাসচিব ড. ইউসেফ এ আল-ওথাইমিন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান-কি-মুন, ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক এবং ইউনেস্কোর সাবেক মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভো যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।