ডেস্ক নিউজ
বঙ্গবন্ধুর হাতেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়। স্বাস্থ্যকে সংবিধানের মূল অধিকারের অংশ হিসেবে সংযোজন, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যকে গুরুত্বদান, গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান, বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ গঠনসহ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তিনি।
দেশের স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার জন্য তৎকালীন আইপিজিএম অ্যান্ড আর-কে (বর্তমানে শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন এবং এ হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ বেডে উন্নীত করেন। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
গবেষণার জন্য তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। তখন দেশে ছিল মোট আটটি মেডিকেল কলেজ। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে তিনি অধ্যাপকের পদসহ বিভিন্ন পদ সৃষ্টি করেন। বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের স্বাস্থ্য ভাবনা ও পদক্ষেপগুলোর কিছু কথা এ লেখায় উল্লেখ করছি।
দেশের মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট এডুকেশন, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এডুকেশন, সেই সঙ্গে মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিটি বিষয়ে জাতির পিতার অবদান রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষার ডিগ্রিগুলো ব্রিটিশ জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল একে একে বাতিল করে দেয়। এর ফলে আমাদের দেশ থেকে ইংল্যান্ডে গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষা লাভের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
জাতির পিতা তখন অত্যন্ত দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ১৯৭২ সালে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অব সার্জনস (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা করেন। যারা পাকিস্তান থেকে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন, যারা বিদেশ থেকে এমআরসিপি, এফআরসিএস করেছেন, এ ধরনের ৫৪ জন ফেলো নিয়ে বিসিপিএসের যাত্রা শুরু।
জাতির পিতা বিসিপিএস প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলেই এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করে বর্তমানে ৬ হাজারের মতো ফেলো দেশে-বিদেশে কাজ করছেন। ৩ হাজারের মতো চিকিৎসক এমসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করে দেশে কাজ করেছেন- এটি দেশের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতির পিতার অনন্য অবদান বলে আমি মনে করি।
উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়াসহ পঙ্গু হাসপাতালে অর্থোপেডিক সার্জারির ওপর এমএস ডিগ্রি চালু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এভাবে দেশে তিনি অর্থোপেডিক সার্জারির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেন। তাছাড়া পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার ক্ষেত্রে আইপিজিএম অ্যান্ড আর-কে বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শাহবাগে শিফট করেন, তখন শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করে ৩০০ করা হয়। পরে জাতির পিতা এটি আরও বৃদ্ধি করে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর এ হাসপাতালে কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু এ সময় আইপিজিএম অ্যান্ড আরের তৎকালীন ডাইরেক্টর প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলামকে বলেন- ‘দেশের স্বাধীনতার জন্য চিকিৎসকরা এত বেশি শাহাদতবরণ করেছেন, আর কোনো পেশার লোক স্বাধীনতার জন্য এত বেশি শাহাদতবরণ করেনি। প্রফেসর ইসলাম, আমি আপনাকে অনুরোধ করব যেসব শিক্ষক, চিকিৎসক শাহাদতবরণ করেছেন তাদের নাম লিখে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করুন।’ প্রফেসর ইসলাম সেই মহতী কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন। ৮৯ চিকিৎসক দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।
জাতির পিতা চিকিৎসকদের দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন। গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) বঙ্গবন্ধুর সময়েই প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে দেশের ৮টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম বলে বিবেচনা করা হতো।
অবশ্য এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত করার জন্য আমিও মিছিল করেছিলাম এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু বললেন, এক বছরও হয়নি আমি দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, এর মধ্যেই মিছিল করেছে, এরা কারা?
বঙ্গবন্ধু তখন তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মরহুম আবদুর রাজ্জাককে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মালেক উকিলের কাছে পাঠিয়ে দিলেন, আমিও ছিলাম সেখানে। ওই সময় জাতির পিতার নির্দেশে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ৩ মাসের মধ্যে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের একটি পরিত্যক্ত ভবনে বেসিক সায়েন্সে এমবিবিএস চালু হয়।
জাতির পিতার চিন্তা-চেতনা আমাদের চিন্তা-চেতনার চেয়ে বহুগুণে অগ্রসর ছিল। বঙ্গবন্ধু তখন একটা রেফারেল সিস্টেমের কথা বলেছিলেন। প্রতিটি গ্রাম বা ওয়ার্ডে একজন স্বাস্থ্যকর্মী থাকবেন। যে স্বাস্থ্যকর্মী প্রতিটি বাড়ি ঘুরে ঘুরে মানুষের স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেবেন। অসুস্থ লোক থাকলে তাকে চিহ্নিত করে ইউনিয়ন সাব সেন্টারে নিয়ে যাবেন। সেই ইউনিয়ন সাব সেন্টারে একজন ডাক্তার থাকবেন, একজন নার্স থাকবেন, একজন প্যারামেডিক থাকবেন এবং সেখানে রোগীকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করতে না পারলে রোগীকে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠাবেন।
থানা কমপ্লেক্সে রোগী সুস্থ না হলে তাকে মহকুমা হাসপাতালে বা জেলা হাসপাতালে বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হবে। এভাবে একটি রেফারেল সিস্টেমের কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন। জাতির পিতা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন সাবজেক্ট, সাবস্পেশালিস্ট সাবজেক্ট পর্যন্ত চালু করেছেন। প্রফেসরের পদ তৈরি করেছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি কার্ডিও ফিজিওলজি ল্যাব প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর আমলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ইউনিয়নে সাব-সেন্টারগুলো ও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো যাতে নির্ধারিত সময়ের (১৯৭৮) মধ্যেই তৈরি হয় সেভাবেই পরিকল্পনা করেছিলেন। কারণ ইউনিয়নে সাব-সেন্টারগুলো ও থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো যথাসময়ে তৈরি হলে দেশের সব মানুষকে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
জাতির পিতা দেশের জনগণের জন্যই শাসনতন্ত্র তৈরি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু দেশকে প্রতিষ্ঠা ও শত্রুমুক্ত করে যাননি; মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা- অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কতটা জনকল্যাণমুখী ছিলেন বর্তমান সময়েও আমরা তা ভেবে অবাক হয়ে যাই।
বঙ্গবন্ধুর কনসেপ্ট বা চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা নিয়েই আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক খুলেছেন। এ কারণেই তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার চেষ্টা করছি। প্রকৃতপক্ষে, বঙ্গবন্ধুর পথ ধরেই জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের মেডিকেল শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫, সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৮- এর মূলে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদান।
বর্তমানে যখন দেখি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চিকিৎসকরা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য অধ্যয়ন করছেন, চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন, শিক্ষাদান করছেন, তখন বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা খুবই মনে পড়ে। কারণ বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপের ফলে আজকে মেডিকেল শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার এতটা উন্নতি সম্ভব হয়েছে। দেশের মেডিকেল শিক্ষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জাতির পিতা ১৩ বছরেও বেশি সময় ধরে জেল খেটেছেন। আমরা জাতির পিতার ত্যাগকে একটু অনুধাবন করে চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণাকে যেন আরও গুরুত্ব দেই; সেই সঙ্গে চিকিৎসকদের অনান্য মহতী কর্মও যেন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করি।
পরিশেষে বলতে চাই, যে মহান নেতার জন্য আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই দেশকে যিনি সব দিক থেকে পুনর্গঠন করে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন- সেই বঙ্গবন্ধুকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এমনকি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবসহ তার পরিবারের ১৮ সদস্যকে আমরা হারিয়েছি। এটি আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ অনেক আগেই একটি অসাম্প্রদায়িক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতো।
বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্বল বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বর্তমান বাংলাদেশকে জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। সবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার সঙ্গে শাহাদতবরণকারী সব শহীদের প্রতি আমার অন্তরের ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়