ডেস্ক নিউজ
কেবিন নম্বর ১১৭। একটি হাসপাতালে থাকা অসংখ্য কেবিনের মতো এটিও একটি কেবিন। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এই কক্ষটির রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। এর সঙ্গে আছে বাংলা শিল্প ও সাহিত্যের এক অমর স্রষ্টার সম্পৃক্ততা। জড়িয়ে আছে কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি। নির্বাক হয়ে থাকা অসুস্থ জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত এখানেই ছিলেন জাতীয় কবি। সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে কেবিনটি। কক্ষটিতে প্রবেশ করলেই নজরে পড়ে কবির ব্যবহৃত একটি চেয়ার, রিডিং টেবিল ও ড্রেসিং টেবিল। উল্টো দিকেই রয়েছে কবির পোশাক রাখার একটি ওয়্যারড্রব। দেয়ালে ঝুলছে ১৯২৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার কৃষ্ণনগরে ধারণকৃত নজরুল ও তার জীবনসঙ্গী প্রমীলা দেবীর যুগলবন্দী আলোকচিত্র। এমন অনেক আলোকচিত্রের মধ্যে একটিতে স্ত্রীসহ দুই ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ ও কাজী সব্যসাচীর সঙ্গে ফ্রেমবন্দী অবস্থায় নজরুলের দেখা মেলে। শুধু কি তাই? জাতীয় কবির সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিও ঝুলছে দেয়ালে। আরেক ছবিতে কবির অনুরাগী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবও ফ্রেমবন্দী হয়েছেন। এসব ছবির সমান্তরালে খ্যাতনামা চিত্রকরদের রং-তুলির আঁচড়ে চিত্রিত কবির প্রতিকৃতিগুলো নয়নে ছড়িয়ে দেয় ভাললাগার অনুভব।
এমন নানা অনুষঙ্গে বিএসএমএমইউয়ের বি ব্লকের দ্বিতীয় তলার ১১৭ নম্বর কেবিনটি রূপ নিয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকক্ষে। গত বছরের ২৭ আগস্ট কেবনিটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় স্মৃতিকক্ষ। তবে স্মৃতিকক্ষ গড়া হলেও এতদিন সেখানে ছিল না সাধারণের প্রবেশাধিকার। আজ শনিবার নজরুলের প্রয়াণবার্ষিকীর দিনটি থেকে সর্বসাধারণের জন্য খুলে যাচ্ছে কবির স্মৃতিধন্য এই স্মৃতির দুয়ার। আজ বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হবে এই স্মৃতিকক্ষ। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় সকাল আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত খোলা থাকবে নজরুল স্মৃতিকক্ষ।
বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার কথা হয় বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তারই উদ্যোগে ২০২১ সালের ২৭ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকক্ষ। হাসপাতালের ভেতর এমন স্মৃতিকক্ষ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে এই চিকিৎসক জনকণ্ঠকে বলেন, নজরুলের গান কিংবা কবিতা আমাদের অনুপ্রাণিত ও আলোড়িত করে। সেক্ষেত্রে হাসপাতালে চিকিৎসা শেষ করে ঘরে ফেরার আগে এই স্মৃতিকক্ষে প্রবেশ করে যে কেউ উজ্জীবিত হবে। বাড়বে সদ্য রোগমুক্ত হওয়ার মানুষটির মনোবল। তাছাড়া যাদের কারণে বাঙালী বাঙালীর হিসেবে আমরা গর্ববোধ করি তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম তিনজন হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই তিনজনের মধ্যে আবার নজরুলের সঙ্গে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ সখ্য। এমনকি বঙ্গমাতাও ছিলেন জাতীয় কবির অনুরাগী। এমন বাস্তবতায় আমি যখন হাসপাতালের দায়িত্ব নেই তখন মনে হলো কেবিনটিতে নজরুলের স্মৃতিকে ঘিরে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার পদধ্বনি শোনা যায়। সেই সূত্রে বাঙালীর কাছে স্মরণীয় তিন ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া রয়েছে এই কেবিনে। এখানে শুধু একটি কক্ষ বড় বিষয় নয়, তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ইতিহাস। আমার হৃদয়ের সেই অনুভূতি থেকে নজরুল স্মৃতিকক্ষ প্রতিষ্ঠা উদ্যোগ নেই। আর এ পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
এরপর অনুসন্ধানের মাধ্যমে হাসপাতালের রেকর্ড রুম থেকে নজরুলের ব্যবহৃত আসবাবপত্র নিয়ে আসা হয়। নজরুল যে বিছানাটি ব্যবহার করতেন সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালের অন্য একটি বেড সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নজরুল ইনস্টিটিউটের সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো হয় স্মৃতিকক্ষটি। এর বাইরে ঠাঁই পেয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত বিভিন্ন চিত্রশিল্পীর আঁকা নজরুলের প্রতিকৃতি। ভবিষ্যতে এই স্মৃতিকক্ষে ঠাঁই পাবে নজরুলের হাতের লেখা পান্ডুলিপি। বাজবে কবির রচিত উদ্দীপনামূলক নজরুলসঙ্গীত।
আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য এই স্মৃতিকক্ষ খুলে দেয়া হবে কাল (শনিবার)। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। এছাড়াও নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারসহ বিশিষ্টজনরা উপস্থিত থাকবেন।
কবির বিভিন্ন বয়সের নানা অভিব্যক্তির আলোকচিত্র রয়েছে হাসপাতালে। তার মধ্যে একটি ছবিতে ধরা দিয়েছে হাসপাতালের অবস্থানকাল কবির ৭৪তম জন্মদিন। বিশেষ দিবসটি নজরুলের গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছেন শেখ মুজিব। আরেক ছবিতে আলো-ছায়ায় দৃশ্যমান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা তারুণ্যের নজরুল। পিতৃরূপে কবিকে খুঁজে পাওয়া কাজী অনিরুদ্ধ ও কাজী সব্যসাচীকে কোলে তুলে নেয়া আলোকচিত্রে। পারিবারিক এই ফ্রেমে সংযুক্ত হয়েছেন প্রমীলা দেবীও। ইতিহাসের সাক্ষ্যবহ একটি ছবিতে কলকাতার রাজভবনে বঙ্গবন্ধুর হাতে নজরুল রচিত ‘চল চল চল’ শীর্ষক বাংলাদেশের রণসঙ্গীতের স্বরলিপি তুলে দিচ্ছেন কাজী অনিরুদ্ধ। ১৯২২ সালে ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশের সুবাদে কবিকে আশীর্বাদ জানানো রবীন্দ্র ঠাকুরের বাণীও ঠাঁই পেয়েছে একটি ফ্রেমে। একই ফ্রেমে যুক্ত হয়েছে কবির অনন্য সৃষ্টিকর্ম সঞ্চিতা, মায়ামুকুর, বিষের বাঁশী বইয়ের প্রচ্ছদ। সঙ্গে রয়েছে নজরুলের ছবিযুক্ত একটি সঙ্গীত সঙ্কলনের প্রচ্ছদ। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ধানম-ির কবি ভবনে ধারণকৃত একটি ছবিতে নজরুলের সঙ্গে ফ্রেমবন্দী হয়েছেন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা। ভালবাসায় গল্পময় আরেক ছবিতে হাসপাতালে শায়িত কবির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। এসব আলোকচিত্রের সঙ্গে আলপ্তগীন তুষার, কামাল উদ্দীনসহ বিভিন্ন চিত্রশিল্পীর আঁকা নজরুলের প্রতিকৃতিসমূহ সমৃদ্ধ করেছে ইতিহাসের স্মারক স্মৃতিকক্ষটিকে।