ডেস্ক নিউজ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত নেপথ্য মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে একটি ‘তদন্ত কমিশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে শিগগিরই কাজ শুরু হচ্ছে। সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। তারা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, অবশেষে ৪৫ বছর পর জনগণের একটি দাবি পূরণ করতে যাচ্ছে সরকার।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ৩৫ বছর পর ২০১০ সালে সেই বর্বর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কয়েকজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
আদালতের রায়ে হত্যাকাণ্ডের পেছনের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ ছিল। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত উঠে আসেনি। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের বিলম্ব হলেও বিচার হয়েছে। তবে ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনের ষড়যন্ত্রকারী বা কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচিত হয়নি। তাদেরও বিচার করার দাবি দীর্ঘদিনের। বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাে র নেপথ্যে কারা জড়িত এবং কারা ষড়যন্ত্র করেছিল, এসব বিষয় উদ্ঘাটনে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কার্যক্রম শুরু করা হবে। আপনারা মুজিবর্ষেই একটা কিছু দেখতে পাবেন।’
কেন এই কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কারা ছিল- সমাজে এবং রাষ্ট্রে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা না গেলে তাদের অনুসারীরা হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন করতে পারে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন আমাদেরও আছে, সেটাও নষ্ট করতে পারে। সেজন্য বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শেখ হাসিনা শেষ করেছেন। এর পরের অধ্যায় হচ্ছে, নেপথ্যে কারা ছিল, এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে কারা জড়িত ছিল, তাদের চিহ্নিত করা। ইতিহাসের স্বার্থে নেপথ্যের শক্তিকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
আইনমন্ত্রী বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সাবেক সেনাসদস্যদের বিচার হলেও এর পেছনের রাজনীতি এবং ষড়যন্ত্রের বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। সেজন্য সরকার কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে টার্গেট করে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন আনিসুল হক।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কমিশনকে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ রাখতে চেয়ারম্যান ও অন্য সদস্য পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে চিন্তাভাবনা ও আলোচনা চলছে। কমিশন গঠনের ব্যাপারে সংশ্নিষ্টরা শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন। কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া ও এর কাজের ধরন কী হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সরকার আলোচনা করবে এবং তাদের মতামত গ্রহণ করবে বলে জানা গেছে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচার বন্ধ করে রাখা হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১০ সালে কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় যাদের শাস্তি হয়েছে, তারা মূলত আত্মস্বীকৃত খুনি। তবে এ ঘটনার ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে তদন্ত কিংবা বিচার হয়নি। হত্যার নেপথ্যে জড়িতদের খুঁজে বের করা জরুরি বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। তারা মনে করেন, সামরিক বাহিনীর বিপথগামী কিছু অফিসার ও সৈনিকই শুধু এই ন্যক্কারজনক হত্যাকা ঘটায়নি। এর পেছনে অনেক বড় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কাজ করেছে।
জানা গেছে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পর পরই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় বিভিন্ন দেশে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যার পর সে দেশে সাত দিনের মধ্যে ওয়ারেন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী হত্যার পর কাপুর কমিশন, দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর থ্যাকার কমিশন ও রাজীব গান্ধী হত্যার পরও জৈন কমিশন গঠন করে সরকার।
বিশিষ্টজনের সাধুবাদ : তদন্ত কমিশন গঠনের উদ্যোগকে ‘খুব ভালো’ বলে মনে করেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি সমকালকে বলেন, এই নৃশংস হত্যার সঙ্গে কোনো বিদেশি শক্তি, দেশীয় এজেন্ট, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জড়িত কিনা সেসব বিষয় উদ্ঘাটন অবশ্যই করা দরকার। জাতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত ছিল। তিনি বলেন, কমিশন গঠনের আগে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন নিতে হবে। টার্মস অব রেফারেন্স কী হবে তা নির্ধারণ করতে হবে।
সরকারের এ উদ্যোগকে ‘সাধুবাদ’ জানিয়ে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সমকালকে বলেন, তদন্ত কমিশন গঠন সময়ের ও গণমানুষের দাবি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা চায় একটা তদন্ত কমিশন গঠন হোক। তিনি বলেন, নৃশংস এই হত্যার পেছনে জড়িত কুশীলবদের চিহ্নিত করা হয়নি। তাদের অনেকেই পরপারে চলে গেছে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে অবশ্যই কমিশন গঠন করা উচিত। আন্তর্জাতিকভাবে কারা এবং কোন কোন ব্যক্তি এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল, তা জানতে শক্তিশালী তদন্ত কমিশন গঠন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সমকালকে বলেন, কমিশন গঠন দীর্ঘদিনের দাবি। রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর জেলহত্যা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা সম্পর্কে উচ্চ পর্যায়ের শক্তিশালী তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। কারা তাদের মদদ ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল, সেসব খুঁজে বের করা দরকার। সে সময় যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের ভূমিকা কী ছিল, সেসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত গ্রহণ করে সমন্বিতভাবে একটা প্রতিবেদন তৈরি করা দরকার। পঁচাত্তরের পরে এসব ঘটনার বহু আলামত নষ্ট করা হলেও বিক্ষিপ্তভাবে তথ্য-প্রমাণ যা আছে সেটা দিয়েই কাজ শুরু করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষ ছিলেন না। একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। তার কন্যা শেখ হাসিনা সাধারণ আদালতেই ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করেছেন। হত্যার নেপথ্যে ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে এখন দরকার তদন্ত কমিশন গঠন। অবশেষে সরকার আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করতে যাচ্ছে শুনে খুবই খুশি হয়েছি।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে প্রজাতন্ত্রের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। তাদের বিচারের আওতায় আনা যাবে কিনা সেটা পরের বিষয়। একটা তদন্ত প্রতিবেদন রাষ্ট্রের কাছে থাকা উচিত।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক সমকালকে বলেন, জাতির পিতা বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে এটা জঘন্যতম ঘটনা। এ জাতীয় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে জাতি ও বিশ্বমানবতার ইতিহাসের কাছে আমরা দায়ী থাকব। তাই এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হওয়া প্রয়োজন। এ কারণে একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী কমিশন গঠন করে অপরাধীদের চিহ্নিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি।