ডেস্ক নিউজ
স্বপ্ন নয়, পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতা! প্রমত্তা পদ্মার দুই পাড়ের মধ্যে এমন এক সংযোগ গড়ে তোলা হলো, যা নিয়ে এতদিন দেশের মানুষ শুধু আশায় বুক বেঁধেছে। সেই আশার বেলুনে এবার লেগেছে উত্তুঙ্গ হাওয়া। কথিত দুর্নীতির অভিযোগ, ভয়াবহ স্রোতের বাধা এবং নিজস্ব অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে দেশের বৃহত্তম এই সেতু। এবার মানুষের চোখে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চল ও পদ্মার দুই পাড়ের উন্নয়ন নিয়ে স্বপ্ন খেলা করছে। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে, পদ্মা সেতুকে ঘিরে এর দুই পাড়কে গড়ে তোলা হবে হংকংয়ের মতো উন্নত ও সমৃদ্ধ জনপদে। যার প্রভাবে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনীতি। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো। এই সেতুকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে পুরো দেশের অর্থনীতি বদলে যাবে। দক্ষিণাঞ্চল তথা বাংলাদেশের কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই পদ্মা সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। পদ্মার দুই পাড়ে অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা নতুন নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসবেন। বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোনে স্থাপন হবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা। পদ্মা সেতুই হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নদীর পাশেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অলিম্পিক ভিলেজ, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নৌ-বন্দর, অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল, বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, ইকোনমিক করিডোর গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই ইকোনমিক করিডোরকে কার্যকর করার জন্য পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে রেল, সড়ক ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো গড়ে তোলা হবে সমন্বিত মাল্টিমোডাল যোগাযোগব্যবস্থা। সড়ক, নৌ, আকাশপথের সঙ্গে সহজ ও সাশ্রয়ী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠার পাশাপাশি এবং স্থাপনা তৈরির জন্য প্রচুর জমি থাকায় পদ্মার দুই পাড় হয়ে উঠবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ‘কমার্শিয়াল ও বিজনেস হাব’। সংশ্লিষ্টরা জানান, দক্ষিণ চীন সাগর তীরবর্তী শহর হংকং-এর আদলে পরিকল্পিত সুসজ্জিত নগরী হিসেবে পদ্মা সেতুর দুই তীরবর্তী এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পদ্মা নদীর পাশেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অলিম্পিক ভিলেজ, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নৌ-বন্দর, অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল, বিশেষ অর্থনৈতিক জোন স্থাপন করা হবে। এর সঙ্গে দক্ষিণের জেলাগুলোকে যুক্ত করে পুরো এলাকাটিকে গড়ে তোলা হবে অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে। এই সেতু দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগসূত্র স্থাপন করবে তাই নয়, একে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলায় ইতোমধ্যে শিল্পায়নের কাজ শুরু হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখে দোতলা এ সেতুতে যানবাহনের পাশাপাশি রেলসংযোগ স্থাপন হচ্ছে। এ পথটি ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পাশাপাশি পটুয়াখালীর পায়রা সমুদ্রবন্দর ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘এনার্জি হাব’ তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেলে পাল্টে যাবে দক্ষিণাঞ্চলের আর্থসামাজিক চিত্র। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অর্থনীতিতে যোগ হবে ৯২ হাজার কোটি টাকা : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পর্যালোচনা বলছে, পদ্মা সেতু চালুর পর দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে প্রায় ১ শতাংশ হারে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতে, এ সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ ও আঞ্চলিক জিডিপি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমাদের জিডিপি ৪৫০ বিলিয়ন ডলার হলে, পদ্মা সেতুতে রেল এবং সেতু একত্রে চালুর ফলে, অর্থনীতিতে বছরে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ১০ বিলিয়ন (১ হাজার কোটি) ডলার যোগ করবে। এই সেতু নির্মাণে আমাদের যে খরচ ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার তার সাড়ে ৩ গুণ বেশি আমাদের অর্থনীতিতে যোগ করবে।’ স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হলে জিডিপি ১ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার গবেষণা ছিল। এখন মনে হয়, সেটি ২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। পদ্মা সেতুর টাকা, যেটা ২৫ বছরে ফেরত আসার কথা; এখন দেখা যায়, সেটি ১৫-১৬ বছরে উঠে আসবে।’
সরাসরি উপকৃত হবে ৩ কোটি মানুষ : বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে, যা মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। এ সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে। কমবে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ। বদলে যাবে কৃষিতে উন্নত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান। খুব সহজেই স্বল্পতম সময়ে তাদের কৃষিপণ্য রাজধানী ঢাকায় চলে আসবে। যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে। এ সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ভবিষ্যতের বাংলাদেশ : ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথার পাঁচ দশক পরে এসে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ আরও একটি বীরত্বগাথা রচিত হতে দেখল। তীব্র স্রোত নিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা পদ্মা, যার বুক দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে (মাওয়া পয়েন্টে) ১ লাখ ৪০ হাজার ঘন মিটার পানি প্রবাহিত হয় (বিশ্বে আমাজন নদী ছাড়া আর কোনো নদী দিয়ে এত বেশি পানি প্রবাহিত হয় না); এমন একটি নদীর তলদেশে পিলারের পর পিলার তুলে, নিজস্ব অর্থায়নে দুই পাড়ের মধ্যে যে সংযোগ গড়ে তোলা হলো- এটিকে কেবল একটি সেতু না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাহসী বীরত্বগাথা বলেই মন্তব্য করেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। তার মতে, এই সেতু নির্মাণে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, বারবার নানা ধরনের বাধা তৈরি হয়েছে- সেসব বাধা অতিক্রম করা মোটেও সহজ ছিল না। এতসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে প্রমত্তা পদ্মার বুকচিরে দুই পাড়ের মধ্যে যে সেতুবন্ধ রচিত হলো সেটি তো আসলে ভবিষ্যতের উন্নত বাংলাদেশকেই প্রতিফলিত করে। ইতিহাসের স্মরণীয় এই দিনটিকে মাথায় রেখে তিন বছর আগে এই কথাটিই এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ও প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী। প্রয়াত এই শিক্ষাবিদ সেই সময় বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার কথাবার্তা হচ্ছে। নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। …এই সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রেও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।’