ডেস্ক নিউজ
২০২০ সালে সরকার অনেকটা হঠাৎ করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ওই বছরের ১ জুলাই থেকে এসব পাটকল বন্ধ করে দেয়। সরকারি ভাষ্যমতে, জন্মলগ্ন থেকে এসব পাটকল ক্রমাগতভাবে লোকসানে থাকাই এগুলো বন্ধের কারণ। তবে পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণার আগে সরকার পিপিপির মাধ্যমে সেগুলো চালু রাখার কথা বলে। এরই ধারাবাহিকতায় বন্ধ পাটকল বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সচল করতে ভাড়াভিত্তিক ইজারা দিচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) তত্ত্বাবধানে থাকা ২৫টি পাটকলের মধ্যে ১৭টি বন্ধ পাটকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেয়া হবে। বিজেএমসি জানিয়েছে, দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রফতানি বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য আন্তজার্তিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে যাতে দেশি-বিদেশি বা যৌথভাবে উভয়েই দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। ইজারার মেয়াদ পরবর্তীতে বাড়ানো যাবে এমন শর্তে প্রথমে ৫-২০ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হবে। ইজারা পেলে পাটকলের জমিতে কেবলমাত্র পাট ও পাটজাত পণ্য এবং বহুমুখী পাটজাত পণ্যের জন্যই ব্যবহার করা যাবে।
কিন্তু ইজারা দেয়া কোনো সম্পত্তি বা এর কোনো অংশ কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা মধ্যস্থতাকারীসহ কোনো পক্ষের কাছে বন্ধক রাখা যাবে না, সাব-লিজ বা ভাড়া দেয়াও যাবে না।
মাসিক সমন্বয় সভায় দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, বীরপ্রতীক বলেন, আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বিজেএমসির বন্ধ মিলসমূহ দ্রুত ভাড়াভিত্তিক পদ্ধতিতে লিজ গ্রহণের সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকে (এফডিআই) অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
স্বাধীনতার আগে পাটকল ছিল ৭৫টি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্টের এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় বিজেএমসি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২টি। ১৯৮২ সালের পর ৩৫টি পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ, ৮টি মিলের পুঁজি প্রত্যাহার ও ১টি পাটকল একীভূত করা হয়। ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের পাটখাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন সময়ে ১১টি মিল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়।
২০০২ সালে আদমজী জুট মিলস বন্ধ করা হয়। এর পর বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীনে বর্তমানে পাটকল আছে ৩২টি। ৫টি মিলের মামলা আদালতে বিচারাধীন। একটিতে ভিসকোস উৎপাদন প্রকল্প নেয়া হয়েছে আর একটিতে বিক্রয়োত্তর মামলা রয়েছে।
সর্বশেষ তিনটি নন-জুট মিলসহ সচল ছিল ২৫টি। তবে অব্যাহত লোকসানের কারণে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সবগুলো পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। মিলগুলো বন্ধ থাকায় গত সেপ্টেম্বর থেকে স্বেচ্ছায় অবসর বা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে শ্রমিকদের পাওনা নগদ ও সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে পরিশোধ করা হচ্ছে।
বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ২৫টি মিলের মধ্যে ৪টি মিলের (জাতীয়, খালিশপুর, দৌলতপুর ও কেএফডি) মিলের শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধ করা হয়েছে। ৩৪ হাজার ৭৫৭ স্থায়ী শ্রমিকদের ২ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে পাওনার ক্ষেত্রে অর্ধেক নগদে ও অর্ধেক তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বন্ধ থাকা এসব জুটমিলের মধ্যে ১৭টি ইজারা দিবে সরকার। এসব মিলগুলোর ৫টি চট্টগ্রাম অঞ্চলের, ঢাকা অঞ্চলের ৪টি ও খুলনা অঞ্চলের ৮টি।
বিজেএমসির তথ্যানুযায়ী, ঢাকা জোনে পাটকল ৭টি। যার মধ্যে চারটি ইজারা দেয়া হবে। মিলগুলো হচ্ছে- ইউএমসি জুট মিলস, নরসিংদী; বাংলাদেশ জুট মিলস, ঘোড়াশাল রাজশাহী জুট মিলস এবং জাতীয় জুট মিলস, সিরাজগঞ্জ। চট্টগ্রাম জোনে মিল ১০টি, যার মধ্যে পাঁচটি ইজারা দেয়া হবে। মিলগুলো হচ্ছে- হাফিজ জুট মিলস, এম.এম জুট মিলস, সীতাকুণ্ডের আর.আর জুট মিলস; গুল আহমেদ জুট মিলস, কুমিরা; কেএফডি জুট মিলস, রাঙ্গুনিয়া।
খুলনা অঞ্চলের আটটি মিলই ইজারা দেয়া হবে। মিলগুলো হলো- প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস, ক্রিসেন্ট জুট মিলস, ইস্টার্ন জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, স্টার জুট মিলস, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং কারপেটিং জুট মিলস লিমিটেড। রাষ্ট্রায়াত্ত্ব পাটকলসমূহে কাঁচাপাট প্রক্রিয়াজাত করণের মাধ্যমে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়। বর্তমানে হেসিয়ান, স্যাকিং, সিবিসি, ব্লাংকেট, এবিসি (জিওজুট), পাটের সূতা, ডাইভারসিফাইড জুট ব্যাগ ও কাপড় উৎপাদিত হয়।
পাটের বহুমুখী পণ্য যেমন- ফাইল কভার, ফ্যাশন ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ, লেডিস হ্যান্ড ব্যাগ, সেভিং কিটস, নার্সারি পট, নার্সারি সিট, জুট টেপ, কুশন কাভার, পর্দা ও কাপড়, রঙিন কাপড় ছাড়াও রটপ্রুফ পাটের কাপড় এবং কাপড় দ্বারা রটপ্রুফ পাটের কাপড়ের ব্যাগ ইত্যাদি উৎপাদিত হয়।
বিজেএমসির সচিব এ এফ এম এহতেশামূল হক বলেন, পাটকলগুলোর উন্নয়নের জন্যই মূলত ইজারা দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা যারা বিনিয়োগ করবে, তারা নতুন নতুন পণ্য আনবে। পাটজাত পণ্যে বৈচিত্র্যায়ন করবে। প্রতিযোগিতা বাড়বে। অনিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বিজেএমসির পরিচালিত পাটকলে লোকসান ৫৭৩ দশমিক ৫৮ কোটি টাকা। আগের বছর বা ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৪৯৭ দশমিক ১৮ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যায়নি। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে হিসাব অনুযায়ী, সরকারি পাটকলগুলোতে মোট সম্পদ ২৫ হাজার ৩৫২ দশমিক ৪৬ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি সম্পদ রয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জুটমিলগুলোতে। পাটকলে স্থায়ী সম্পদের মূল্য ১৪ হাজার ৩২৯ দশমিক ৯৮ কোটি টাকা। স্থায়ী সম্পদ হচ্ছেÑ ভূমি, ভূমি উন্নয়ন, দালান কোঠা ও অন্যান্য, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও সরঞ্জামাদি, পরিবহন ও মোটরযান এবং অন্যান্য সম্পদ।
পুঞ্জীভূত অবচয় বাদ দিয়ে নিট স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ ১২ হাজার ২৮২ দশমিক ৮২ কোটি টাকা। নিট স্থায়ী সম্পদ বেশি ঢাকা অঞ্চলের জুট মিলে। মিলগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৮ হাজার ৩৫৬ দশমিক ৩৬ কোটি টাকা, যাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ খুলনা অঞ্চলের মিলগুলোতে। মোট চলতি দেনা ২ হাজার ৩৮৭ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা, যাতে সবচেয়ে বেশি চলতি দেনায় রয়েছে খুলনা অঞ্চলের মিলে।
জুটমিল লিজের শর্ত :
পাটকলগুলো লিজ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত দিয়েছে বিজেএমসি। শতভাগ দেশীয় ও বিদেশি মালিকানা এবং দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা যৌথভাবে পাটকল ইজারায় এক্সপ্রেস অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) দেখাতে পারবে। একজন ব্যক্তি একের অধিক মিল লিজ পাওয়ার জন্য দরপত্র জমা দিতে পারবে। আগ্রহীরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিলের পর ১০০ পয়েন্টে চূড়ান্ত মূল্যায়ন হবে। ইজারা পাওয়ার পর তাদের নিজস্ব নামে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সেইসঙ্গে লিজের পুরো মেয়াদেই মাসিক ভাড়া দিতে হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের তারিখের দশম মাস থেকে মাসিক ভাড়া দিতে হবে। পাঁচ বছর পর থেকে ভাড়া ১০ শতাংশ বাড়বে। ইজারাদার বা সরকার লিজের অধীনে থাকা মিলগুলোর কোনো কার্যক্রমে অংশে নেবে না। পাশাপাশি কোনো লাভ বা ক্ষতির ভাগিদারও হবে না।