ডেস্ক নিউজ
৩ জুন, ১৯৭৮ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। সেনাপ্রধানের পদে থেকে নাটকীয় এক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন জিয়াউর রহমান। রাজনৈতিক দলগুলোকে কোণঠাসা করে নিজেই গঠন ‘জাগদল’ নামের একটি দল। এরপর তথাকথিত সেই নির্বাচন শেষে নিজেই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। জিয়াউর রহমানের সামরিক উর্দি ও অস্ত্রের ভয়ে দেশের গণমাধ্যম অনিয়মের বিষয়ে চুপ থাকলেও, বিদেশি গণমাধ্যমে তা ফলাও করে প্রচারিত হয়। এই নির্বাচনে জিয়া কোনো কোনো এলাকায় ১১০ ভাগ ভোট পেয়েছেন বলেও প্রমাণসহ বিভিন্ন বিদেশি সংবাদপত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপি সম্পর্কে পাকিস্তানের দি হেরাল্ড পত্রিকায় বলা হয়, ‘বিএনপির জন্ম ছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার নীলনকশার ফলশ্রুতি।… এই দলের জন্য যে দর্শন নির্ধারণ করা হয় তা হলো: আওয়ামী লীগের দুর্বল স্থানে আঘাত করা এবং জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব জাগ্রত করা।… নিন্দিত আওয়ামী লীগার, চরম বামপন্থী ও মুসলিম লীগারদের নিয়ে দলের জনবল বাড়ানো হয়।’
এর আগে, ১৯৭৭ সালে এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে ক্ষমতাচ্যুত করে, অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। এরপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে একটি হ্যাঁ-না ভোটের আয়োজন করেন তিনি। লোক দেখানো সেই ভোটের আগে, বিক্ষোভের ভয়ে, রাস্তায় কোনো মানুষকে পর্যন্ত বের হতে দেওয়া হয়নি। এমনকি কোনো প্রচারণাও করা হয়নি। ভোটের দুদিন আগে সড়কের পাশের দেয়ালে, চলমান রিকশা-বাস ও মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি থামিয়ে জোড় করে জেনারেল জিয়ার সামরিক পোশাক পরিহিত পোস্টার সাঁটিয়ে দেওয়া হয়। এক ধরনের আতঙ্ক ছড়ানো হয় মানুষের মধ্যে।
ভোটের দিন ভয়ে কেউ বের হওয়ার সাহস পায়নি। ফলে ভোটারবিহীন থেকে যায় ভোটকেন্দ্রগুলো। এক পর্যায়ে মানুষ খুঁজে না পেয়ে, শেষ পর্যন্ত স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীকে ভোট দিতে নিয়ে যাওয়া হয়। দিন শেষে ঘোষণা আসে, ৯৯.৪ ভাগ ভোট পেয়ে একচেটিয়াভাবে জয় লাভ করেছেন জেনারেল জিয়া।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিরাবের হত্যার পর সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন তিনি আর তার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালেও জিয়াউর রহমান মূলত ছিলেন একজন মেজর। ১৯৭৫ সালের মধ্যেই তিনি মেজর জেনারেল এবং উপ-সেনাপ্রধানের পদ পেলেন। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মদদ দিলেন। দখল করলেন সেনাপ্রধানের পদ। এরপর প্রহসনের বিচারে হত্যা করলেন শত শত মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যকে। এমনকি যে কর্নেল তাহের তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, তাকেও হত্যা করলেন। মার্শাল ল অর্ডিন্যান্স জারি করে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। বন্দি করলেন রাজনীতিবিদদের। একপর্যায়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্রের মুখে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। নষ্ট করে দেন নির্বাচনি ব্যবস্থা। তার হাতে খুন হয়ে যায় বাংলার মানুষের ভোটের অধিকার। দেশ থেকে হারিয়ে যায় গণতন্ত্র।
স্বৈরাচার জিয়াউর রহমান প্রথমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এরপর নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতে ধ্বংস করে দিয়েছেন দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা। হ্যাঁ-না ভোট নামের একটি তামাশার প্রচলন ঘটিয়েছেন। এমনকি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করে, ভোটারবিহীন ভোটের প্রবর্তকও তিনি। জিয়াউর রহমানের অবৈধ ক্ষমতার মোহের কারণেই স্বৈরাচারী ব্যবস্থাপনায় পতিত হয় বাংলাদেশ। ফলে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটে।
জিয়াউর রহমান শুধু বাংলাদেশের গণতন্ত্রকেই খুন করেননি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন তিনি। জিয়াউর রহমানের হস্তক্ষেপে লিবিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি আশ্রয় পায় জাতির পিতার খুনিদের একটা বড় অংশ। এসময় লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানসহ অন্যান্য খুনিদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের ব্যবস্থা করেন তিনি। এমনকি তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা জনশক্তি রফতানির কোম্পানি খোলে এবং বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় লোক পাঠানোর ব্যবসা করে। এছাড়াও কন্সট্রাকশান কোম্পানির ব্যবসা করে অনেক টাকার মালিক হয় তারা এই সময়ে। এমনিক তাদের সমর্থকদের লিবিয়ায় নিয়ে, অস্ত্র চালনার অত্যাধুনিক ট্রেনিং দিয়ে, দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থাও করে এই খুনি চক্র। জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমা টিকিয়ে রাখার জন্য এদের শতভাগ পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন।
ভোটারবিহীন নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের শতভাগ ভোটের বিজয় এবং স্বৈরাচারী শাসন চালুর ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রুদ্ধ করে দেওয়ার জন্য, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি প্রচলনের জন্য, জাতির কাছে জিয়াউর রহমান মীরজাফরের সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। জিয়াউর রহমানের দেখানো পথে ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি, খালেদা জিয়াও জনগণকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এক ভোটারবিহীন নির্বাচন আয়োজন করেন। কোনো দল ওই সাজানো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায়, নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে কুমিল্লা-৬ আসন থেকে জিতিয়ে আনেন বঙ্গবন্ধুর খুনি ও ফ্রিডম পার্টির আবদুর রশিদকে।