ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
রাষ্ট্রীয় সত্তা অর্জন পরবর্তী জাতিগঠণের (nation – building) নিরিখে বাংলাদেশ এখনও একটি অসম্পূর্ণ ও অপরিণত রাষ্ট্র। এমন মন্তব্য দুটো কারণনির্ভর। এক, বাঙালি ও বাংলাদেশী বিভাজন, যা অবশ্য পুরোটাই অভ্যন্তরীন রাজনীতির অনাকাংক্ষিত ফসল, এবং ইতিহাসবর্জিত। জাতীয়তাবাদ দীর্ঘ ও ধারাবাহিক ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তন ও আবর্তনের চূড়ান্ত পরিণতি; জাতীয়তাবাদের লেবেল তৈরি করে তা রাতারাতি কোন জনগোষ্ঠীর ওপর সেঁটে দেয়া সম্ভব নয়। দুই, প্রায় অর্ধশতাধিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বাস বাংলাদেশের প্রান্তিক অঞ্চলে (limitrophic region) যারা সাংবিধানিকভাবে নাগরিক হলেও জাতিসত্তার বিচারে স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। কিন্তু এমন নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যে অতিরিক্ত মাত্রা সংযোজন আন্তর্জাতিক মহল প্ররোচিত।
অন্যদিকে বাঙালি জাতিসত্তাকে এককভাবে গুরুত্ব দেয়ার অর্থ ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহকে অস্বীকার করা। জনান্তিকে শ্রুত মত অনুসারে এ সমস্যা সমাধানের জন্য বাঙালির পরিবর্তে বাংলাদেশী লেবেল বেছে নেয়া হয়েছিল; কিন্তু যা বালখিল্যসুলভ ও অনৈতিহাসিক।[1] কলমের এক মোচড়ে বা কারও এক কথায় হাজার বছরের ইতিহাস পাল্টে দেয়া যায় না। আর বাঙালিত্বের ওপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া আসলে গরিষ্ঠের ঔদ্ধত্যের ব্যাপার। (majoritarian arrogance), যা গণতন্ত্রের ধরণ হিসেবে নিন্দিত। বিকল্প কাংক্ষিত গণতন্ত্রের ধরণ বহুত্বভিত্তিক গণতন্ত্র (pluralist or polyarchic democracy)। কিন্তু এখনকার বাংলাদেশ মেধাশূন্য নেতৃত্ব ও সংস্কৃতিহীন রাজনীতির শিকার; ফলে কাজীর গরুর মতো আমাদের গণতন্ত্র- খাতায় আছে, গোয়ালে নেই; সংবিধানে আছে, বাস্তবে নেই।
এমন একটি অসম্পূর্ণ ও অপরিণত রাষ্ট্রব্যবস্থায় মেধাহীন নেতৃত্বের কারণে আদিবাসী প্রশ্নটি যে সংকট হয়ে উঠবে তা-ই স্বাভাবিক। বর্তমান নিবন্ধটির বক্তব্য আদিবাসী দাবিটির প্রশ্নবিদ্ধ সারবত্তা, ঐতিহাসিকতা এবং সে কারণে যৌক্তিক অসারতা নির্দেশ করা। শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইস্যুটির স্রষ্টা জাতিসংঘের নেতৃত্বে পশ্চিম দুনিয়া। শত শত বছর সারা পৃথিবী শোষণ করে স্ফীত হওয়া পুঁজিবাদী দুনিয়া এখন লগ্নি পুঁজির কারবারি। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তাদের এ বোধ ও অভিধা যে তাদের মানবিকতাবোধ উৎসারিত তা, বিশ্বাস করার মতো তথ্য- প্রমাণ আমাদের হাতে অপ্রতুল। বরং কোন্ উদ্দেশে আচম্বিতে এ অভিধার চয়ন তা তলিয়ে- খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
নৃতত্ত্বের মূল থেকে বিষয়টির বিবেচনা শুরু করা যেতে পারে। সমস্যার শিকড় নিহিত ethnicity এবং nation এর দ্বৈততার (dichotomy) মধ্যে। সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বে ethnicity শব্দ ও সংশ্লিষ্ট ধারণার সূত্রপাত করেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ভেবার (Max Weber)। তার সংজ্ঞায়নে ethnicity হল, “Those human groups that entertain a subjective belief in their common descent because of similarities of physical type or of customs or because of memories of colonization and migration; this belief must be important for group formation; furthermore, it does not matter whether an objective blood relationship exists..” ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী এ্যান্থনী স্মিথ বলেন, “an ethnicity is group of human beings whose members identify with each other, usually on a presumed or real common heritage.”[2] রক্তসম্পর্কের বন্ধন ছাড়াও যে ethnicity-চেতনা গড়ে ওঠার অনেক বাস্তবিক ও ঐতিহাসিক কারণ আছে তা ম্যাক্স ভেবার স্বীকার করেন। অন্যদিকে nation- ও প্রায় সমধর্মী এক প্রপঞ্চ। দীর্ঘকাল একদল জনগোষ্ঠী এক ভূখণ্ডে অধিবাস করে অভিন্ন ঐতিহ্য ও চেতনার অধিকারী হলে তারা nation হয়। অর্থাৎ nation হলো, ঐতিহাসিক পরম্পরাভিত্তিক এক গোষ্ঠী মানুষের চেতনা (a state of mind)। পশ্চিম দুনিয়ায় জাতি-রাষ্ট্র (nation – state) গড়ে উঠতে থাকলে nation এবং ethnicity-র বৈপরীত্য পরিস্ফুট হয়। জাতি- রাষ্ট্রের ধারণা, এমন রাষ্ট্র সব ethnicity-র প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু লঘিষ্ঠ অন্যান্য ethnicity তা মনে করে নি। ফলে তারা কখনও সমতাভিত্তিক সাঙ্গীকরণ, (assimilation), কখনও স্বায়ত্তশাসন (autonomy) বা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা (independence) দাবি করেছে। সুতরাং মৌলিক সমস্যা হলো, nation – state শব্দযুগলের মধ্যে, যা এখন সেকেলে ও বাতিলযোগ্য। এখন হওয়া উচিত nation – state; কারণ সংখ্যায় ক্ষুদ্র হলেও ethnicity-র nation হবার সব বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গরিষ্ঠ ethnicity -র ঔদ্ধত্যে এমন ঐতিহাসিক সত্য বিস্মৃত হয়। এমন বিস্মৃতির শিকার যারা তাদেরকে স্বনামখ্যাত ইতিহাসবিদ বার্নার্ড লুইস (Bernard Lewis) বলেছেন blundering amnesiacs। বাংলাদেশসহ অনেক রাষ্ট্রই এখন blundering amnesiacs -এর মতো আচরণ করে। উপরন্তু, নৃতত্ত্ব অনুযায়ী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে উপজাতি (tribe) ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী (ethnic minority) বলা গ্রহণযোগ্য নয়; এরা ক্ষদ্র জাতিসত্তা (small national entities)। ক্ষুদ্রতা সংখ্যাবাচক, গুণবাচক নয়।
কিন্তু এ ক্ষুদ্রজাতিসত্তার আদিবাসীত্ব অযৌক্তিক এক সংকটের উৎস। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও যুক্তি এদের এমন অভিধার স্বীকৃতি দিতে নারাজ। আদিবাসী শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ indigenous, যার অর্থ the people regarded as the original inhabitants of an area (Oxford Advanced Learner’s Dictionary)। বুৎপত্তিগতভাবে আদিবাসী শব্দটির অর্থও অভিন্ন। নৃতত্তবিদ লুই মর্গান Louis Morgan) মনে করেন, ““The aboriginals are the groups of human race who have been residing in a place from time immemorial. They are the sons of the soil.”[3] এখন প্রশ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের অধিবাস তারা কি ভূমিপুত্র হিসেবে দাবি করতে পারে? যদি না পারে তাহলে তারা আদিবাসী হয় কীভাবে? জাতিসংঘ এযাবতকালের সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের পুঞ্জিত জ্ঞানকে নস্যাৎ করে যেন আদিবাসী নামের এক উদ্ভট (প্রায়োগিক বিচারে) শব্দ আবিষ্কার করেছে। সে কথায় পরে আসছি; এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্ত্বাসমূহের অতীত ইতিহাস সংক্ষেপে জানা যাক।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে ১৪ টি জনগোষ্ঠীর অধিবাসঃ ১. চাকমা; ২. মারমা; ৩. ত্রিপুরা; ৪. তঞ্চঙ্গা; ৫. লুশাই; ৬. পাংখো; ৭. খিয়াং; ৮. মারমা; ৯. মুরঙ; ১০. উচাই; ১১. বম; ১২. খুমি; ১৩. চাক ও ১৪. সুজে সাঁওতাল।[4] ইতিহাসের নিরিখে মোটা দাগে বললে, এরা কেউ ভূমিপূত্র নয়; সবাই বহিরাগত। কিন্তু স্বীকার্য, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এরা হয়ে গেছে ভূমিজ সন্তান। অতীতে এদের আদিবাস যেখানেই থাক, যেখান থেকে কোন কারণে তাদের আগমণ হোক না কেন ওরা বৃহত্তর বাঙালি সত্তার সংগে ভাগ করে নিয়েছে অভিন্ন বাসভূমি। একই অর্থে শংকর বাঙালি জাতির মিলিত ধারার মিথস্ক্রিয়ার ফসল আজকের বাঙালি জাতিকে কি অভিবাসী বলবো? নিশ্চয়-ই নয়। প্রাচীন ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্যরা অভিবাসী থাকেনি, হয়েছে ভূমিলগ্ন সন্তান, গড়েছে সারা বিশ্বের বিমুগ্ধ বিস্ময়ের সভ্যতা- সংস্কৃতি। একই অর্থে বর্তমানের মার্কিন নাগরিক আর অভিবাসী নয়, তারা সবাই এক মহা melting pot- এ লীন হয়ে গেছে। কিন্তু এদের কাউকে তো আদিবাসী বলা হলো না। আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ১৭ সতকের গোড়া থেকে ইউরোপীয় অভিবাসন শুরু হয়। ঠিক একই সময়ে পার্বত্য জনপদবাসীদেরও অভিবাসন শুরু হয়। তাহলে অভিবাসী মার্কিনীদের আদিবাসী না বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীদের কেন আদিবাসী বলা হচ্ছে? ব্যাখ্যা বোধ হয় এই যে, মার্কিন মুল্লকে রেড ইন্ডিয়ান নামে আদিবাসী আছে। ওদের ক্ষেপিয়ে তুললে অশনি সংকেত অনিবার্য। সুতরাং বিশ্বপুঁজিবাদপোষিত বুদ্ধিজীবী- গবেষক সে দিকে পা মাড়ান নি। তারা আগ্রহী তৃতীয় দুনিয়ার দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর প্রতি। কারণ নানা ছলছুতোয় এমন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতে পারলে পুঁজিবাদী অনুপ্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণের পথ সুগম হয়।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের আনাগোনা শুরু হয় ষোল শতক থেকে। এ সময়ে আসামের মিজোরাম থেকে কুকি নামের উলঙ্গ জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। এদের অনেকে এদিক Ñ সেদিক বিচরণ করে ফিরে যেত; কিন্তু কেউ কেউ বসতি গড়ে, যাদের পরবর্তী প্রজন্ম আজও বিদ্যমান। একই সময়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী খাগড়াছড়ি এলাকায় বন কেটে বসত গড়ে, এবং জুম চাষ শুরু করে। ১৬৬০-এর দিকে, অর্থাৎ সতের শতকের মাঝামাঝি চাকমাদের একটি দল আদিবাস আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে রামু থানার অদূরে সাময়িক অবস্থান নেয়। তারা পরে আরো গহীন অরণ্য আলী কদমের দিকে এবং রাঙামাটির দিকে যায় স্থায়িভাবে বাস করার জন্য। মগ বা মারমা জনগোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটে ১৭৮৪Ñর দিকে। প্রায় একই সময়ে বোমাঙদেরও আগমন ঘটে। মোটামুটিভাবে বলা যায়, আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের অধিবাস তাদের অভিবাসন হয়েছিল ষোল থেকে আঠারো শতকের মধ্যে।
১৯৯৭-র ২ ডিসেম্বর যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা যে দীর্ঘ এবং প্রলম্বিত আলোচনার ফসল তার কোন পর্যায়েই আদিবাসী দাবির সপক্ষে কোন প্রসঙ্গ ওঠেনি, বা চুক্তিতেও শব্দবন্ধটি স্থান পায় নি। কিন্তু ২০০৭-এর জাতিসংঘ ঘোষণার পর থেকে আদিবাসী সংক্রান্ত দাবিটি শ্রুত হচ্ছে। জাতিসংঘের ঘোষণাটিতে এমন জনগোষ্ঠীর জন্য আকর্ষণীয় বেশ কিছু প্রসঙ্গ আছে। যেমন তাদের আতœঅধিকার, অভ্যন্তরীন ও স্থানীয় বিষয়ে স্বায়ত্তশাসন, ভূমির ওপর অধিকার, নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা, সামরিক কার্যক্রম প্রত্যাহার; এবং এমন লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে জাতিসংঘের সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা। এছাড়াও প্রসঙ্গক্রমে আলোচ্য আই এল ও কনভেনশন। ’৫৭-র ১০৭ নং কনভেনশন বাংলাদেশ অনুমোদন করে ১৯৭২-এ। এ কনভেনশনের বিশেষ দিকগুলো ছিল:
– জনগোষ্ঠীসমূহকে জাতীয় মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে।
– তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে রাষ্ট্র সহায়ক হবে।
– ভূমির ওপর তাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।
– নিরাপত্তা বা আর্থ-সামাজিক উদ্দেশে রাষ্ট্র এমন জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার জমি ব্যবহার করতে পারবে, তবে এলাকার জনগণের মতামত প্রয়োজন হবে, এবং যথাযথ পুনর্বাসন / ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
-এমন জনগোষ্ঠী দেশের প্রচলিত এবং অভিন্ন আইনে বিচারযোগ্য হবেন।
বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধানে এমন জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত দু’টি বিশেষ ধারা আছে। ২৩ ধারায় বলা হয়েছেঃ “রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।” বোধগম্য যে, রাষ্ট্রীয় সামগ্রিক স্বার্থে আই এল ও কনভেনশন এমন ধারায় পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলিত হয় নি। কিন্তু ২৮ (৪) নং ধারায় ব্যাপকভাবে বলা আছে , “নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।” সংবিধানের এমন দিকনির্দেশনা এবং সরকার / রাষ্ট্রের বাস্তব ভূমিকার মধ্যে কোন ফারাক আছে কী না বা এমন জনগোষ্ঠী কোনভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছে কী না, তা প্রসঙ্গান্তরে বিবেচ্য হতে পারে; এবং সে ক্ষেত্রে পার্বত্য জনপদবাসী সহমর্মিতার দাবিদার হতে পারেন।
১৯৮৯-এর আই এল ও কনভেনশন-১৬৯ বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিব্রতকর ছিল; ফলে তা অনুমোদিত হয় নি। এ কনভেনশনে জনগোষ্ঠীসমূহকে প্রকারান্তরে আদিবাসী (পুরনো / চিরস্থায়ী) বলা হয়েছিল। উপরন্তু, ছিল:
– সব ক্ষেত্রেই তারা স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হবে, এবং রাষ্ট্র তা নিশ্চিত করবে।
– তাদের আত্মপরিচয় তাদের নিজস্ব-আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে বিবেচিত হবে।
-এমন এলাকায় কোন খাস জমি থাকবে না। আর প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অভিমত প্রাধান্য পাবে।
উল্লেখ্য, এ কনভেনশন অনুমোদন করলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতো। বলা যেতে পারে, জাতিসংঘের ২০০৭-এর ঘোষণা এ কনভেনশনের সম্প্রসারণ মাত্র।
চূড়ান্ত মন্তব্য
পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অধিবাস তারা ইতিহাসের নিরিখে মূলত অভিবাসী। কিন্তু এখন অভিবাসী নয়, নাগরিক-বাংলাদেশের যে কোন নাগরিকের মতোই। কিন্তু তারা আদিবাসী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোনটিই নয়, তারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, এবং তা আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে। সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আর বড় জাতিসত্তা বাঙালি নিয়ে বাংলাদেশ। সুতরাং বাংলাদেশ মানচিত্রের ভেতর কোন গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি যুক্তিযুক্ত হলেও তার আত্মঅধিকার প্রয়োগের প্ররোচনা অনাকাংক্ষিত ও বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রসূত। একই সমান্তরালে বিবেচ্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের উন্নয়ন ঘাটতি ও অধিকার বঞ্চনার বিষয়সমূহ। সুতরাং মনে হয়, সংবিধান ও শান্তিচুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলে বাইরের কোন দুরভিসন্ধি হালে পানি পাবে না। উপরন্তু, প্রয়োজন জনগোষ্ঠীসমূহের বাস্তবানুগ দৃষ্টিভঙ্গী ও ভূমিকা। অবশ্য সর্বাগ্রে অনুঘটকের ভূমিকা সরকারের-ই; এবং যাতে কোন ভ্রান্তি ও অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কালক্ষেপন দেশ ও সরকারের জন্য আত্মবিনাশী হবে।
[1] বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য Syed Anwar Husain, Bangladesh, National Scenario, Foreign Policy and SAARC (Dhaka: Agamee Prokashoni, 2003.
[2] Max Weber, “Economy and Society” in Guenther Roth and Claus Wittich (eds.) Trans. Ephraim Fischof vol. 2. (Berkeley, University of California Press, 1998); Anthony D. Smith, The Ethnic Origins of Nations (Oxford: Blackwell, 1986).
[3] Louis Morgan, An Introduction to Anthropology, 1972.
[4] দ্রষ্টব্য Syed Anwar Husain, War and Peace in the Chittagong Hill Tracts (Dhaka: Agamee Prokashoni, 1999) P. 48. অবশ্য সুজে সাঁওতাল এ তালিকায় নেই, এদের সন্ধান পেয়েছি ২০০৭-এ ঐ এলাকায় তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে।
♦ লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়