ডেস্ক নিউজ:
এই বঙ্গে সব ধর্মের, সব বর্ণ গোত্রের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। সে কারণে সম্প্রীতির ঐতিহ্য প্রকৃতিগতভাবে লালিত এই মাটিতে। বাঙালির ইতিহাসে যা কিছু মহৎ, যা কিছু বৃহৎ তার সবটাই এই সম্প্রীতির শক্তিতে গড়া; সম্প্রীতির এই শক্তি বাঙালির সভ্যতা নির্মাণ করেছে, অগ্রসর হওয়ার শক্তি জুগিয়েছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা অন্যান্য নাগরিকের মতো সামাজিক নিরাপত্তা, সম্পদ সুরক্ষা ও যথাযথ মর্যাদা নিয়েই বসবাস করছে। সকল ধর্মের মানুষের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রীতিময়, সৌহার্দ্যপূর্ণ। সমাজে তারা মিলেমিশে বসবাস করে। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। দেখা হলে সালাম, আদাব, নমস্কার ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে।
সমতার সাথে নিজেদের কার্যাদি সমাধান করে। দেশের সরকার, প্রশাসন, আদালত, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবখানেই সংখ্যালঘুরা সামানে সমান সুযোগ পাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে সংখালঘুরা প্রধান্য পাচ্ছে। এদেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলেও সরকারি কর্মচারির প্রায় ২৫% সংখ্যালঘুরা। এছাড়া বেসরকারি অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। মুসলমানরা তাদেরকে যথাযথ মর্যাদা দেয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন উজ্জ্বল নমুনা বিশ্বের আর কোন দেশে খোঁজে পাওয়া বিরল। বিশ্বের অনেক দেশের জন্য ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উদাহরণ হতে পারে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে একত্রে বসবাস করে এসেছে। সকল ধর্মের মানুষ একসাথে কৃষি কাজ করে, জেলেরা একসাথে মাছ ধরে, তাঁতিরা একসাথে তাঁত বুনে, ব্যবসায়ীরা একসাথে ব্যবসা করে, একই হোটেলে বসে একসাথে গল্প করে, চা-নাস্তা করে, গাড়ির পাশের সিটে বসে দূর-দূরান্ত সফর করে, একই অফিসে এক সাথে চাকরি করে, একই টেবিলে বসে আহার করে, কেউ কারো সাথে সংঘাতে জড়ায় না। কেউ কাউকে উৎখাত করতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুরাই রক্ত দেয়নি; সংখ্যালঘুদের অনেকেই রক্ত দিয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই মিলে শত্রুর মোকাবেলা করেছে।
এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মডেল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম। মুসলমানরা এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলমানরা প্রবল ও সংখ্যায় বেশি হওয়ার কারণে সংখ্যালঘু দুর্বলকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে না। বিশ্বের যেসব দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন-নীপিড়নের কথা শোনা যায় না। কারণ, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য নয়। ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম। মানবতার ধর্ম। অন্যায়ভাবে কাউকে আঘাত করা, কারো বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, উচ্ছেদ করে দেওয়া, কারো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বেঘাত সৃষ্টি করা ইসলামের শিক্ষা নয়।
স্বাধীনতার পর সবাই আশা করেছিল বাংলাদেশ হবে আধুনিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে অনেকটাই ‘পাকিস্তানি লিগেসির’ কাছে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদশের মৌল চেতনাকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা বোধ কাটানো যায়নি।
বাংলাদেশ আজ নতুন করে ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়ছে। এ লড়াইয়ের মূল শক্তি সম্প্রীতির শক্তি। এ লড়াইকে এগিয়ে নেয়র বিকল্প নেই কারণ স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির প্রতিপক্ষরা সম্মিলিত উদ্যোগে আগ্রাসন চালাচ্ছে। এ আগ্রাসনকে রুখতে সব মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস চাই; সম্প্রীতির শক্তির পুনরাভিযান চাই। মুসলমান, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের পূর্ণ সম্প্রীতি চাই। বাংলাদেশ এমন এক রাষ্ট্র হোক যেখানে সবল বা বড়দের হাতে দুর্বল বা ছোটরা বিপন্ন হবে না; সব মানুষ, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার লাভ করবে। এই বাংলাদেশে আমরা সাতচল্লিশ, পঞ্চাশ বা একাত্তরের অমানবিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না। মনে রাখা উচিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা আদিবাসীদের মর্যাদা সংরক্ষণ সংখ্যাগুরুদের সম্মানিত করে, লাভবান করে, ক্ষতিগ্রস্ত করে না। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনায় ফিরতে হবে; এর কোনো বিকল্প নেই। এর বাস্তবায়ন হলেই কেবল ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণহীন ও সাম্যের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সে লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির যে কোনো আঘাত প্রতিহত করতে হবে। নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হবে।