- এপ্রিলে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে আলোচনা
- প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির পরামর্শ বিশ্লেষকদের
আগামী এপ্রিলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন- ইইউ তাদের নতুন জিএসপি প্লাস স্কিম সুবিধা দেয়ার বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মানদণ্ড পর্যালোচনা করবে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হবে। সেই আলোচনার পর বাংলাদেশের জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্স (জিএসপি) ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে নতুন করে আশার আলো দেখছেন অনেকেই। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের শাসনামল শেষ হয়ে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জিএসপি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাই এখন থেকেই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলওর কনভেনশন অনুযায়ী শ্রম আইন সংস্কার, শ্রম অধিকার উন্নয়ন ও মানবাধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসের তিন মাস পরে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ওবামার শাসনামলে জিএসপি সুবিধা বাতিল করা হয়। সে বছরের নবেম্বরেই বাণিজ্য সুবিধা ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ টিকফা স্বাক্ষর করে। ২০১৬ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়নের পর টিকফার বৈঠকে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের আবেদন করেছিল বাংলাদেশ। বৈঠকে উপস্থিত মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ট্রাম্পের শাসনামলে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু এখন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে এবং ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইউএসটিআর) বেশিরভাগ বিধিমালা প্রণয়নে সফল হয়েছে সরকার।
জানা যায়, অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা জিএসপি স্কিম পুনর্গঠন করছে ইইউ। তারা জিএসপির পরিবর্তে জিএসপি প্লাস স্কিম চালু করতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হবে। এর পর তিন বছর জিএসপি সুবিধা বহাল থাকবে। উত্তরণ পর্বে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যার আগাম প্রস্তুতি এখন থেকে নিতে হবে।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত মহাসচিব ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সাধারণ পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, এ বছরের জুন-জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপির বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করবে। এর আগে মার্চ-এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তির (টিকফা) বৈঠক হতে পারে। তিনি বলেন, জিএসপি সুবিধা পুনরায় চালু করার ব্যাপারে আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দিতে পারি।
মার্কিন প্রশাসনের পরিবর্তনকে সারা বিশ্বের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ইতিবাচক মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সদস্য মোস্তফা আবিদ খান জানান, জিএসপি সুবিধা পুনরায় ফিরে পেতে বাংলাদেশ নতুন কোন পদক্ষেপ নিতে পারে। বিটিটিসি মনে করছে বাইডেন প্রশাসনও চীনের প্রতি বাণিজ্য নীতিতে তেমন কোন পরিবর্তন আনবে না। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সঙ্কটের মধ্যে ভিয়েতনামে বাণিজ্যের প্রসার হওয়ায় দেশটির বাণিজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কাঁচামালের জন্য বাংলাদেশ চীনের ওপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কিছু সুবিধা পেতে পারে। তবে চীন বিশ্বের উৎপাদন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রস্থল এবং চীনের সরবরাহ ছাড়া পণ্য উৎপাদন সম্ভব নয় বলে জানান আবিদ খান। ড. মোস্তফা আবিদ খান জানান, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের তুলা থেকে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশের অনুমতি চেয়েছে। তিনি জানান, এ সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ এখন আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন প্রশাসন বরাবর আবেদন জানাতে পারবে। অনুমোদন দেয়া হলে তা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক বলে মন্তব্য করেন এ বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ।
বাইডেনের ক্যাথেরিন তাই-কে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগের পরিকল্পনাকেও ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। যদিও নিকট ভবিষ্যতে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিধিমালা শিথিল হবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক পরামর্শক হওয়ায় ক্যাথেরিন বৈশ্বিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ নেবেন, এমনটাই আশা করা হচ্ছে। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের (আরসেপ) সঙ্গে পাল্লা দিতে বাইডেন প্রশাসন ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপে (টিপিপি) যুক্তরাষ্ট্রের পুনরায় যোগদানের ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনা করতে পারে বাইডেন প্রশাসন।
এ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ এশিয়ান ন্যাশনের (আসিয়ান) ১০টি সদস্য রাষ্ট্রÑ অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড নিয়ে গঠিত হয়েছে এ জোট। এ জোটের আওতাভুক্ত দেশগুলো বিশ্বের অর্ধেক টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্য রফতানি করে।
রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মার্কিন কৌশল নির্ধারণের চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বাইডেন প্রশাসনের সামনে। বারাক ওবামার পিভট টু এশিয়া নীতির হাত ধরে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বাণিজ্য জোটে প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প এ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়ায় তা অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এখন টিপিপির কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে কিনা তাই দেখার বিষয়। এদিকে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখছে আরসেপে চীনের যোগদান।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সম্পর্কিত নানা বিষয় যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে তুলে ধরবে ও সমাধান করবে তাই যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বিপত্তি। এর প্রভাব পড়বে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। অনেক মার্কিন বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিদ্যমান বাণিজ্য নীতির কারণে চীন সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ, মুদ্রা কারসাজি, দুর্বল শ্রম মানদণ্ড, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি আইন বাস্তবায়নে উদ্যোগের অভাব- বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় চীন বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি পরিবর্তনে চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে পারে বলে মনে করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) পরিচালক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। তবে বাণিজ্য ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত লক্ষ্যমাত্রা এখনও পরিষ্কার নয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কার্য পদ্ধতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বৈশ্বিক নীতি ও আইন অনিশ্চিত ও অস্পষ্ট হওয়ায় এ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
জানতে চাইলে সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানির ৫ ভাগের ৩ ভাগ যায় ইউরোপে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই তৈরি পোশাক পণ্য ইভিএর আওতায় জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে। তিনি জানান, যখন এলডিসি থেকে উত্তরণ সময়সীমা শেষ হয়ে যাবে তখন এই সুবিধা থাকবে না। ফলে বাংলাদেশ রফতানি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। এ অবস্থায়, জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে আগেই জিএসপি ক্লাবে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই অন্তর্ভুক্তি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। আইএলওর কনভেনশন অনুযায়ী, শ্রম আইন ও শ্রম অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি মানবাধিকারও নিশ্চিত করতে হবে, মনে করেন তিনি।