ডেস্ক নিউজ
বিদেশী ঋণসহায়তা প্রাপ্তিতে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। আর এতে স্বস্তিতে রয়েছে সরকার, মহামারীকালেও অর্থসঙ্কটে পড়তে হয়নি। ব্যাংক থেকে খুব একটা ঋণ নিতে হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৪১৭ কোটি ৬০ লাখ (৪.১৭ বিলিয়ন) ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে টাকার অঙ্কে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা) এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি। এর আগে ছয় মাসে এত বেশি বিদেশী ঋণসহায়তা কখনই পায়নি বাংলাদেশ। যদিও নানা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বর্তমানে পাইপলাইনে রয়েছে ৫০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ লাখ ২৮ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বাংলাদেশকে ৪৩৯ কোটি ৯৯ লাখ ৬০ হাজার (৪.৪০ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। দিয়েছে ৪১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ছাড় করা ঋণসহায়তার মধ্যে ৪০২ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। ১৫ কোটি ৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার খাদ্য অনুদান এবং ১৪ কোটি ৮৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার প্রকল্প অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৩০০ কোটি ১২ লাখ ৩০ হাজার (৩ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করেছিল দাতারা। এ হিসাবেই এই ছয় মাসে বিদেশী ঋণসহায়তা বেড়েছে ৩৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া যাচ্ছে। এতে করোনার টিকা খাতে ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ মেটাতে কোন সমস্যা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে দ্রুত ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে। আমরা (সরকার) আমাদের প্রয়োজনের বিষয়টি তাদের ভালভাবে উপস্থাপন করেছিলাম। তারা দ্রুত সাড়া দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে। সে কারণে করোনার ধাক্কা সামলে খুব দ্রুতই আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি, যা বিশ্বের অনেক দেশই পারেনি।’ বিদেশী ঋণের এই গতি আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছেন শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘চলমান প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি করোনা মোকাবেলার জন্যও মোটা অঙ্কের ঋণ পাওয়া গেছে। এখনও পাওয়া যাচ্ছে, ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’ ‘আমরা আমাদের প্রয়োজনের কথা সঠিকভাবে দাতাদের কাছে উপস্থাপন করেছিলাম। সে কারণেই তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। আর এই ঋণসহায়তা এবং আমাদের সরকারের দেড় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব যতটা পড়ার কথা ছিল, ততটা পড়েনি।’
শামসুল আলম বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি করোনার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। আমদানি রফতানিসহ অর্থনীতির সব সূচকই এখন ভাল। সব মিলিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, করোনা মহামারী আমরা ভালভাবেই মোকাবেলা করেছি। মাঝে টিকা নিয়ে একটু সমস্যা থাকলেও এখন আর নেই। প্রচুর টিকা আছে, আরও আসছে। টিকার আর কোন সঙ্কট হবে না। আর টিকা কিনতে অর্থেরও কোন সমস্যা হবে না।’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী বর্তমানে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিদেশী ঋণ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারকে যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে। পরপর দুই বছর ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ফরেন এইড অবাক করার মতো, চলতি অর্থবছরেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। এই কঠিন সময়েও সরকারকে কোন ধরনের অর্থসঙ্কটে পড়তে হয়নি। উন্নয়ন কাজ থেমে থাকেনি, টিকা কিনতে সমস্যা হয়নি। আর এসব কারণেই কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ডলারের বাজারে অস্থিরতা ছাড়া কিন্তু অর্থনীতি ভালভাবেই চলছে।’
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭১০ কোটি (৭.১ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশী ঋণ আসে বাংলাদেশে। ওই বছর ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পাওয়া গিয়েছিল। গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ঋণ পাওয়া গেছে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। সংস্থাটি ২৭০ কোটি ডলার ছাড় করেছিল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছাড় করেছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ১৭০ কোটি ডলার। বাংলাদেশে বিদেশী ঋণ ছাড়ের প্রবণতা বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থ ছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসেছিল ৬৫৪ কোটি ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, নানা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বর্তমানে পাইপলাইনে রয়েছে ৫০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ লাখ ২৮ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের প্রায় সমপরিমাণ অর্থ রয়েছে পাইপলাইনে। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি রয়েছে আরও ১৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে কয়েক বছর ধরে বৈদেশিক ঋণ ও পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক অর্থের পরিমাণ বাড়ছে বলে জানায় ইআরডি। পাইপলাইনে বৈদেশিক অর্থ থাকা প্রসঙ্গে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব (অনুবিভাগ প্রধান) মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেগা প্রকল্প বাড়ার কারণেই মূলত পাইপলাইনে থাকা বৈদেশিক অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। যেমন- রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ১১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে খরচ হয়েছে মাত্র তিন বিলিয়ন। বর্তমানে এক প্রকল্পের আওতায় আরও আট বিলিয়ন ডলার পাইপলাইনে আছে। আমাদের ডিপি (উন্নয়ন সহযোগী) কোন ফ্যাক্ট নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি বাড়লেই পাইপলাইনে থাকা অর্থ খরচ বাড়বে। পাইপলাইনে থাকা অর্থ অবমুক্ত করতে কোন উদ্যোগ নেয়া হয় কিনা জানতে চাইলে মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি হলে আমরা পিডিদের (প্রকল্প পরিচালক) নিয়ে বৈঠক করি। আবার প্রকল্পে টাকা ছাড়ে কোন সমস্যা হলে পদক্ষেপ নেই। পাইপলাইনে থাকা অর্থ ব্যবহারের জন্য বড় বড় বাজেট নেয়া হচ্ছে। বাজেট যত বাড়বে ততই পাইপলাইনে থাকা অর্থের খরচ বেশি হবে।
ইআরডি জানায়, সম্প্রতি পিছিয়ে থাকলেও স্বাধীনতার পর থেকে নানা প্রকল্পে বাংলাদেশে ঋণ দেয়ার শীর্ষে রয়েছে বিশ্বব্যাংক। যা মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ। এর পরই ২৩ শতাংশ ঋণ দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এডিবি। মোট বৈদেশিক ঋণের ১৮ শতাংশ জাপান থেকে, ৮ শতাংশ চীন থেকে, ১ শতাংশ দক্ষিণ কোরিয়া, আইডিবি ১ ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী থেকে ১২ শতাংশ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার এখন প্রায় ৪১১ বিলিয়ন ডলার। মোট জিডিপির ১৬ শতাংশই বৈদেশিক ঋণ, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট জিডিপির ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ ঋণ ছিল। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশে।
এডিপিতে বাড়ছে বৈদেশিক ঋণ ॥ ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) অনুমোদন করা হয়েছে, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ২০ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা বেশি। নতুন এডিপিতে সরকার জোগান দিচ্ছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে আসবে বাকি ৮৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা, যা গত বছর ছিল ৬৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পে এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার ২৪ কোটি টাকা।
ঋণ ব্যবহারে শীর্ষে বিদ্যুত বিভাগ ॥ ১৬ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা ব্যবহার করে বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। এর পরই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ব্যবহার করেছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগ ১১ হাজার ১৪৭ কোটি, রেলওয়ে ১০ হাজার ২২৪, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ৮ হাজার ৪১, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ৭ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে নানা প্রকল্পে। এছাড়া সেতু বিভাগ ২ হাজার ৬০০ কোটি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ১ হাজার ২২২ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১ হাজার ১৫১ কোটি টাকা ব্যবহার করছে। ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মোট ৭৫ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশের মেগা প্রকল্প ॥ বাংলাদেশে বিদেশী ঋণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ উচ্চ ব্যয়সম্পন্ন মেগা প্রকল্পগুলো। সরকারের এই মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকায় মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজের জন্য প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিচ্ছে সরকার, যা ২০৪১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি বড় আকারের উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল দেশের যোগাযোগ, পরিবহন ও জ্বালানি খাতকে পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত করা।
ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও বেড়েছে ॥ বর্তমানে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার ঋণ পরিশোধের জন্য ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৬৪৬ কোটি। বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে ১ হাজার ৯০০ মিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার ছিল।