ডেস্ক নিউজ
বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে উৎপাদন সক্ষমতা তিন শতাংশের মতো। বিশ্বব্যাপী বাড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ। দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। খরচ কমাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে গুরুত্ব বাড়াচ্ছে সরকার। জোর দিচ্ছে প্রাকৃতিক উৎস- সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, শহুরে বর্জ্য ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এতে মাথায় থাকছে পরিবেশের সুরক্ষার বিষয়টিও।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্যানুসারে, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৬৬ দশমিক ৬৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে শীর্ষে আছে পিভি সোলার, এরপর ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, জৈব-গ্যাস থেকে ০ দশমিক ৬৩ মেগাওয়াট এবং বায়োগ্যাস থেকে ০ দশমিক ৪ মেগাওয়াট। তবে উৎপাদন ক্ষমতা ৭শ মেগাওয়াট থাকলেও মাত্র ২২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে, যা মোট উৎপাদনের মাত্র এক শতাংশ। তবে এ খাতের উন্নয়নে নানা ধরনের প্রকল্প চলমান।
২০২৩ সালে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে যোগ হবে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ
২০২৩ সালের জুনে শেষ হচ্ছে চট্টগ্রামের বারইয়ারহাটে ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, মোংলার ৫৫ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাবনায় ৬৪ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, নেত্রকোনায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, কক্সবাজারের ইনানীতে ৫০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র, চাঁদপুরে ৫০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ হবে। এগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৩১৯ মেগাওয়াট। তবে সরকারের লক্ষ্য ২০২৩ সালের জুনে এগুলো থেকে কমপক্ষে আরও ২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করা।
বিজ্ঞাপন
বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম-সচিব (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) নিরোদ চন্দ্র মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ২২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। আগামী বছরের জুনে আরও ২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন। পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই আমরা এই বিদ্যুৎ পাবো।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ২১ হাজার ২৯৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে ১০ হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা মোট উৎপাদনের ৫১ শতাংশ। এর পরে ৬৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হয় ফার্নেস অয়েল। উৎপাদন ৫ হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদনের ২৮ শতাংশ। এছাড়া ডিজেল পুড়িয়ে মোট উৎপাদনের ৬, কয়লা পুড়িয়ে ৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে মোট উৎপাদনের এক শতাংশ বিদ্যুৎ। ২০৩০ সালের মধ্যে এটা ১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। বর্তমানে ৯টি সৌরশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণকাজ চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। এছাড়া একটি বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পেরও কাজও চলছে, যেখান থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে।
এছাড়াও ১২টি সৌরশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি করা হচ্ছে, যেগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫শ মেগাওয়াট। আরও কয়েকটি বায়ু ও বায়োমাস বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজও চলছে, যাদের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ১৩০ মেগাওয়াট।
২০২১ সালে জামালপুরের মাদারগঞ্জে ১শ মেগাওয়াট সোলার পার্ক প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২৪ সালে এখান থেকেও ১শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে। ফেনী নদীর মোহনায় সোনাগাজীর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকেও ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে।
নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে একগুচ্ছ প্রকল্প
নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে একগুচ্ছ প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম খুলনা তেরখাদায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, চুয়াডাঙ্গায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ৪২ মেগাওয়াট বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, পাবনার ঈশ্বরদীতে ৭০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, জামালপুরে ১০০ মেগাওয়াট সোলার পার্ক, জামালপুরে ৮৫২ কিলোওয়াট রুফটপ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, সিলেটে ১০ মেগাওয়াট সোলার পার্ক, পঞ্চগড়ে ৫০ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, চাঁদপুরে সাত মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, নীলফামারীর ডিমলায় ৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ২০ মেগাওয়াট সৌর পার্ক, ধামরাইয়ে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জে ৬ মেগাওয়াট বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, এগুলোর কাজ চলমান। ২০২৪ সালের জুন নাগাদ এখান থেকে সুফল মিলবে। এছাড়া আরও ২৮টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প পাইপ লাইনে আছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং একটি টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী দলগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে আসছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে আমরা অনেক আশাবাদী। বর্তমানে এর জেনারেশন ক্যাপাসিটি ৭শ মেগাওয়াটের বেশি। এছাড়া জামালপুরে যমুনা নদীর পাড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় ১শ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর কাজ শুরু হয়েছে। ফেনী নদীর মোহনায় সোনাগাজীর বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকেও ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে।
‘প্রকল্পগুলো চালু হলে বিদ্যুৎখাত আরও এগিয়ে যাবে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন বড় একটা ইস্যু। এজন্যই মূলত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। সেজন্য একাধিক প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিজমিতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের নিষেধাজ্ঞা আছে। এটা তুলে নিতে হবে। বৈশ্বিকভাবে যদি বিদ্যুৎ তৈরির উপকরণের দাম বাড়ে তবে বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণ হবে। বর্তমানে এক ইউনিট বিদ্যুৎ তৈরি করতে ১০ টাকা খরচ হয়। উপকরণের দাম বাড়লে এটা বেড়ে ২০ টাকা হবে। তবে এক ইউনিট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় ১৫ টাকা। সেক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে দাম বাড়লে আমাদের পুরোপুরি নবায়নযোগ্য উৎসে যেতে হবে।
জামালপুরে দেশের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র
জামালপুরে যমুনা নদীর পাড়ে নির্মাণ করা হবে দেশের সবচেয়ে বড় ১শ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র। ৩২৫ দশমিক ৬৫ একর জমির ওপর গড়ে উঠবে সোলার পার্কটি। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৫১১ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় ভারতীয় ঋণ এক হাজার ১১৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের পর এখান থেকে সুফল মিলবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ পেতে সরকার জামালপুরে ১শ মেগাওয়াট যে কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে, সেটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ ধরনের একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আমরা দেশে সৌরশক্তির বড় অবদানটা বুঝতে পারবো। বিদ্যুতের ট্যারিফ বেশি হলেও পরিবেশের কথা মাথায় রেখে অন্তত এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি।
এ খাতের সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কৃষিজমিতে সোলার পার্ক করায় আমরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। ফলে আমাদের সম্ভাবনা সীমিত। যদি এক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দিতাম ভালো হতো। বিশ্বের অনেক দেশই কিন্তু ছাড় দিচ্ছে। রুমানিয়া নতুন আইন করেছে কৃষিজমিতে সোলার পার্ক করার বিষয়ে।
তিনি বলেন, কৃষিজমিতে বুঝেশুনে ছাড় দেওয়া যায়। এক শতাংশ জমি তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি ও শিল্পখাতে। সামনে ফুড ও বিদ্যুৎ নিরাপত্তা জরুরি। তাই কৃষিজমিতে সোলার পার্কের জন্য ছাড় দেওয়া দরকার। সমস্যা হচ্ছে সোলার পার্ক করতে গেলে পাশেই কৃষিজমি থাকে। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে উপকরণের দাম বেড়েছে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি সোলারে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই।’