ডেস্ক নিউজ
করোনার মধ্যে রফতানি আয়ের উল্লম্ফনের সঙ্গে আমদানিতেও জোয়ার বইতে শুরু করেছে। পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলায় প্রতিমাসেই রেকর্ড হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ মাসে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে বিনিয়োগ ও উৎপাদন সহায়ক পণ্য বা মেশিনারিজ। একইসঙ্গে বেড়েছে কাঁচামাল ও উৎপাদন পরিস্থিতিও। এছাড়া গতবছর ব্যাংকগুলোতে জমে থাকা তারল্যের পাহাড়ও কমতে শুরু করেছে। বেসরকারী খাতের ঋণের চাহিদা বাড়ায় দুই বছর পর ২ অঙ্কের ঘরে জায়গা করে নিয়েছে প্রবৃদ্ধি। ফলে করোনার কারণে বিনিয়োগে কিছুটা ভাটা পড়লেও তা আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সর্বশেষ তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ২০ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বেশি। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘আমদানি বাড়ার ভালো দিক হচ্ছে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থান হবে। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে।’ তবে সামনের দিনগুলোতে করোনার ধাক্কা সামলানোই বিনিয়োগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন তারা।
করোনা মহামারীর মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ৭০৪ কোটি (৬৭.০৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এলসি খোলার সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, গত নবেম্বর মাসে ৮১০ কোটি ৭০ লাখ (৮. ১০ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এক মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এত বিপুল অঙ্কের বিদেশী মুদ্রা খরচ দেখা যায়নি। এর আগে গত অক্টোবর মাসে ৭৪২ কোটি ১৬ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল, যা ছিল এক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বর) ৩৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন (৩ হাজার ৫৪২ কোটি ৯২ লাখ) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৩ লাখ ৩ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ২৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে দেশে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এই পাঁচ মাসে গড়ে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে দেশে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-নবেম্বর সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির জন্য ২৩৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ২১ দশমিক ২ শতাংশ। এই সময়ে শিল্প খাতে ভারি যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ১৫৭ কোটি মার্কিন ডলারের। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে হয় ১১৯ কোটি ডলার। একই সময়ে শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানি হয় ১০৮২ কোটি মার্কিন ডলারের। যা গতবছর একই সময়ে ছিল ৭৩০ কোটি ডলার। এ সময় শিল্প খাতে ৩৫২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি কাঁচামাল পণ্য আমদানি হয়েছে। বিকেএমইএ-এর প্রথম সহ-সভাপতি মোঃ হাতেম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য বেড়েছে। দেশে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বেড়েছে ডলারের মূল্য। এ কারণে শিল্প খাতের মূলধনী যন্ত্রাংশ ও ভারি যন্ত্রপাতির আমদানির ব্যয় আগের তুলনায় বেশি। তিনি বলেন, প্রকৃতভাবে এখনও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় আছি আমরা। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে নীতিগত সহায়তা দিচ্ছে সেটি অব্যাহত থাকলে শিল্প খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নবেম্বর সময়ে ৩ হাজার ১১৬ কোটি ৬০ লাখ (৩১.১৬ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গতবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৪ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে ২ হাজার ২৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-নবেম্বর সময়ে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ১ হাজার ৮৬৩ কোটি ৬০ লাখ (১৮.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রফতানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। এ হিসাবেই অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলন, ‘একটা স্বস্তির জায়গা হচ্ছে, আমদানির সঙ্গে রফতানিও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। রফতানির এই ইতিবাচক ধারা বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। তাই, আমদানি যেটা বাড়ছে, তা যদি ঠিকঠাক মতো বিনিয়োগে আসে, তাহলে অর্থনীতির জন্য ভালো হবে। ‘আশার কথা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে আগামীবছর থেকেই যান চলাচল করবে। মেট্রোরেলও পুরোদমে চালু হবে। কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ কাজও শেষ হবে। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে। কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষের পথে। এসব বড় প্রকল্প বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ভিন্নমাত্রা যোগ করবে। ‘আর এসব উন্নয়নযজ্ঞকে কেন্দ্র করেই বিনিয়োগের ছক কষছেন উদ্যোক্তারা। সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পণ্য সরঞ্জাম আমদানি করছেন তারা। তাতেই বাড়ছে আমদানি।’ আহসান মনসুর বলেন, ‘আমদানি বাড়ায় উদ্বেগের কিছু নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এখনও পর্যন্ত রিজার্ভ আছে, সেখান থেকে আমদানির খরচ মেটাতে কোন সমস্যা হবে না।’
এদিকে কমছে ব্যাংকিং খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য। গত জুলাইয়ে মুদ্রানীতি ঘোষণার পর থেকে নবেম্বর পর্যন্ত চার মাসে ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য ২ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে ২ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ আলোচিত সময়ে উদ্বৃত্ত তারল্য কমেছে ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা যায়। গত কয়েক মাস অল্প অল্প করে বাড়লেও অক্টোবর মাসে বেশ খানিকটা বেড়ে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশে উঠে এসেছে এ ঋণ প্রবৃদ্ধি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত নবেম্বরে ব্যাংক খাতে মোট তরল সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৪৭ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। ওই সময়ে ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থ সংরক্ষণের (সিআরআর) দরকার ছিল ৬১ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। বিধিবদ্ধ তরল সম্পদ সংরক্ষণে (এসএলআর) দরকার ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণের পর ব্যাংকগুলোর হাতে ছিল ২ লাখ ১৮ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। যা উদ্বৃত্ত তারল্য হিসেবে ব্যাংক খাতে পরিচিত। গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। মূলত ২০২০-২১ অর্থবছর জুড়েই ব্যাংকে তারল্যের পাহাড় জমতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, করোনা মহামারীর মধ্যে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রমসহ সব ধরনের বিনিয়োগে ভাটা পড়ে। এছাড়া রেমিটেন্সও সে সময় বেশি আসছিল। একইসঙ্গে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নগদ অর্থ ছাড়ের ফলে ওই সময় থেকেই ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য বাড়তে থাকে। তবে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতি ফেরায় গত নবেম্বরে ব্যাংক খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য কমে আসে। করোনার প্রকোপও তখন কমে এসেছিল এবং রেমিটেন্স প্রবাহও কমেছিল। তবে এখন নতুন করে ওমিক্রনের আতঙ্ক ও উদ্বেগ কাজ করছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
এদিকে করোনার কারণে বিনিয়োগ নিবন্ধন কিছুটা ভাটা পড়লেও তা আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই তিন মাসে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ২০ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের এই সময়ে বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। বিডা জানিয়েছে, ১৮৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এই বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। অর্থবছরের তিন মাসে স্থানীয় ১৭৭টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ১৮ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে।