নিউজ ডেস্ক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের দুয়ার খুলেছে। এমন মতই দিয়েছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা। এ দিকে সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল মিয়ানমার সফরে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, প্রতিনিধি দলটি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবে। এ ছাড়া আসিয়ান জোটের মাধ্যমেও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে অপর একটি কূটনৈতিক সূত্র।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইনে হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে প্রাণভয়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এতে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার কিছু তৎপরতা দেখায়। বাংলাদেশের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও করে। পরে মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দীর্ঘসূত্রতার পথ ধরে।
২০১৮ সালের জুনের পর থেকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমার কার্যত কোনো উদ্যোগই নেয়নি। বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক নিয়মিত হলেও তাতে কোনো ফল আসেনি। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানকেও কোনো গুরুত্ব দেয়নি মিয়ানমার। বরং নতুন করে রাখাইনে অভিযান এবং সেনা মোতায়েনের ফলে সংকট আরও জটিল হয়। এমনকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারেও নামে মিয়ানমার। বাংলাদেশও মিয়ানমারের অপপ্রচারের কঠোর জবাব দিচ্ছে।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় চীন ও রাশিয়া। এ দুটি দেশের সর্বাত্মক সমর্থন না থাকলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানে মিয়ানমার উদ্যোগী হবে না, এমন ধারণাই স্পষ্ট হয়। পশ্চিমা বিশ্ব রোহিঙ্গা সংকটকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে দেখলেও চীন চায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এর সমাধান হোক। চীনের এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাশ কাটানোর সুযোগ পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে ওই বৈঠকের পরপরই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের মিয়ানমার সফরের উদ্যোগের মাধ্যমে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের বিকল্প ছিল না। বিশেষ করে চীনের প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে যথাযথভাবে সরাসরি অবহিত করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের মধ্য দিয়ে চীন এখন বাস্তব অবস্থাটা বুঝতে পারছে। এ কারণেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল মিয়ানমার যাচ্ছে। তিনি বলেন, তবে চট করেই এত জটিল সংকটের সমাধান পাওয়া যাবে, সেটা বলা যাবে না। হয়ত আরও এক বছর লাগবে। কিন্তু গত প্রায় এক বছরের যে হতাশার চিত্র, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর সেখানে নতুন আশা দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে বলেও মত দেন তিনি।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান এ অঞ্চলে চীনের নিজের স্বার্থের জন্যও এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন মত দেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর কূটনীতির অনেক দিক থেকেই বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানও এখন ইতিবাচক দিকে ধাবিত হবে, এমন আশাও যুক্তিসঙ্গতভাবে করা যায়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ইন্ডিয়া, মিয়ানমার) এই মুহূর্তে এ অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন চীন সফর করেন, তখনও চীনের নেতা বিসিআইএম করিডোর নিয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেছেন।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন থাকলে বিসিআইএম করিডোর কার্যকর করা সহজ হবে না, এটা চীন বুঝতে পারছে। আর রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান না হলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনও যাবে না। এ ছাড়া চীনের যে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সেটা বাস্তবায়নের জন্যও এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রয়োজন। চীনের বিআরআই উদ্যোগের সফলতার জন্য বেইজিং চাইবে না এ অঞ্চলে কোনো সংকট জটিল থেকে জটিলতর হোক। আগে থেকেই হয়ত এ বিষয়গুলো চীনের বিবেচনাতে ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর এবং চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে এ বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়েছে। ফলে এখন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন আগের চেয়ে আরও উদ্যোগী ভূমিকায় যাবে, এটাই বিশ্বাস করা যায়।
এদিকে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মালয়েশিয়াসহ একাধিক দেশও নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে। মিয়ানমারও এ জোটের সদস্য। এ বিষয়ে হুমায়ুন কবীর বলেন, আসিয়ান থেকে কোনো ভালো উদ্যোগ এলে সেটা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর হতে পারে। কারণ এই মুহূর্তে আসিয়ান জোট চীনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জোট থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হলে মিয়ানমারের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।