ডেস্ক নিউজ
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডে প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাজ্যে। ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ স্যার টমাস উইলিয়ামসের নেতৃত্বে ওই কমিশনে ছিলেন আয়ারল্যান্ড সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড, ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ জেফরি টমাস এবং ব্রিটিশ আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদী আইনবিদ অবরি রোজ। তবে অনুসন্ধান কাজে ওই কমিশনকে বাংলাদেশের ভিসা দেয়নি জিয়াউর রহমান সরকার। ১৯৮২ সালের নভেম্বরে লন্ডনের র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত কমিশনের ‘শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি : প্রিলিমিনারি’ বইয়ে লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ এবং মেজর শরিফুল হক ডালিমকে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ ২১ বছর পর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের কলঙ্কিত ওই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে মদতদাতা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হয়নি। কারা চিত্রনাট্য সাজিয়েছিল, কারা পরিকল্পনা করেছিল, কারা মঞ্চস্থ করেছিল, তাদের নাম প্রকাশ্যে আসেনি। কোনো তদন্ত কমিশন হয়নি দীর্ঘ ৪৭ বছরেও। নতুন করে তদন্তের মাধ্যমে ‘মূল পরিকল্পনাকারীদের’ চিহ্নিত করে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি উঠেছে বারবার। তদন্ত কমিশন গঠনের গণদাবির সঙ্গে একমত সরকারও। কমিশনের রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং চলতি বছরেই তা গঠনের কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এক্ষেত্রে নির্দলীয় ও
দেশি-বিদেশি গবেষকদের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত কমিশনই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সব দিক উন্মোচন করতে পারবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার না করে তাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল রাষ্ট্র। পঁচাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর খুনি মোশতাক জারি করে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স। আর ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এভাবেই রুদ্ধ হয়ে যায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনের সব অর্গল। মুখোশ উন্মোচিত হয়নি কলঙ্কিত ১৫ আগস্টের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি কার্যকর হয় বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি।
কেন তদন্ত কমিশন : বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দুটো ডাইমেনশন। একটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অন্যটি আন্তর্জাতিক। এর কোনোটাই বিচারে উঠে আসেনি। দেশের প্রচলিত আইনে আর দশটা হত্যাকাণ্ড যেভাবে হয়ে থাকে, সেভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। ফলে সুদীর্ঘ ৪৭ বছরেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের বিশদ জানতে পারেনি জাতি। ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা একক দেশীয় ষড়যন্ত্র ছিল না। সেনাবাহিনীর কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত কিছু সেনা অফিসার মিলে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে- বিষয়টি মোটেই এত সরল নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত ছিল বিদেশিদের। যদিও এনএসআই, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আগেই বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা হচ্ছিল। কিন্তু তিনি গ্রাহ্য করেননি।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ঘাতকেরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে হত্যা করতে চেয়েছে। বিচার যথেষ্ট নয়, ষড়যন্ত্রে কারা মদত দিয়েছে, কারা পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল, তদন্ত কমিশন করে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন প্রয়োজন।
বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ (২০২০ সালের আগস্টে) আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ১৯৭৫ : সেটিং দ্য ক্লক ব্যাক’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বলেন, এটি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উদসীনতা দেখায়। যেটা সন্দেহের সৃষ্টি করে। পরে অনেক ডকুমেন্ট পাওয়া যায়। আমার মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্যাপারে আরো তদন্ত দরকার। এই সংযোগগুলোর তদন্ত দরকার। বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের মানুষের এটা নিয়ে কাজ করা উচিত, তাদের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। এর আগে ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট লন্ডনের গার্ডিয়ানে ‘মুজিব হত্যার আড়ালে লুকায়িত নেপথ্য’ প্রতিবেদনে লিফশুলজ লিখেছিলেন, মোশতাক গংরা এক বছরের বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেই জানত। অন্তত ছয় মাস আগে থেকে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আলোচনা-বৈঠক চলছিল।
তদন্ত কমিশন কেন জরুরি- এমন প্রশ্নের জবাবে ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের একটি উদ্দেশ্য ছিল। পটভূমি ছিল। খুনি ফারুক-রশিদ-ডালিমদের পেছনে চালিকাশক্তি ছিল। দেশি-বিদেশি শক্তি ছিল। পরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত ছিল, ইতিহাসের স্বার্থে এ সত্য জাতির জানা প্রয়োজন। তিনি বলেন, কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পর ওয়ারেন কমিশন হয়েছিল। ৫০ বছর হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে কমিশন হওয়া উচিত। কারণ এখনো দেশে-বিদেশে কুশীলবদের অনেকেই বেঁচে আছেন।
প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের গ্রহণযোগ্যতা : ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বঙ্গবন্ধুর খুনে যারা সরাসরি জড়িত ছিল, তাদের বিচার হলেও স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় অন্তরালে থেকে যারা জাতির পিতা হত্যার ছক করেছিলেন, তাদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠনের কথা বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি ওঠে বিভিন্ন মহলে। অবশ্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন গঠন ও শ্বেতপত্র প্রকাশের প্রথম দাবি জানিয়েছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এক যুগ ধরে এই দাবিতে দেশে-বিদেশে অসংখ্য সেমিনার, আলোচনা সভা করে আসছে নির্মূল কমিটি।
এদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করার কমিশনের রূপরেখা প্রস্তুত এবং চলতি বছরেই তা গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। শনিবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মশালায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আশা করছি কিছুদিনের মধ্যে এ আলোচনায় বসতে পারব এবং এ বছর নাগাদ কমিশন চালু করতে পারব। ‘উইচ হান্টিং’ বা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই কমিশন গঠন করা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বদলে দেয়ার যে কলঙ্কিত প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল, যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল তার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, তা নতুন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোর জন্যই এই কমিশন গঠন করা হবে। তবে কমিশনের রূপরেখা সম্পর্কে কিছুই জানাননি মন্ত্রী।
তদন্ত কমিশনের রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত- এমন প্রশ্নের জবাবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি ও গবেষক শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, বিচার বিভাগীয় কমিশন হতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতির পদমর্যাদার বিচারককে দিয়ে কমিশন হতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক গবেষকদের যুক্ত করতে হবে। কমিশনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। দলীয় লোকদের দিয়ে কমিশন করলে হবে না। শুধু দেশীয় ঘাতকদের খোঁজ করলেই হবে না, এদের পেছনে আন্তর্জাতিক ঘাতক কারা ছিল, কারা নেপথ্যে ষড়যন্ত্র করেছে, পাকিস্তান, আমেরিকা কী করেছে, তাদের ভূমিকা কী ছিল, সব আসতে হবে। আরো কোনো দেশ জড়িত ছিল কিনা এসব তথ্য আসবে। আর এসব উত্তর খুঁজতে গেলে মেরুদণ্ড শক্ত কমিশন প্রয়োজন। সরকারকেও শক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে।
তিনি বলেন, দায়সারা গোছের কমিশন দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র উন্মোচন অসম্ভব। যে কোনো সাধারণ হত্যা মামলার তদন্তেও প্রথম প্রশ্ন আসে, এর সুবিধাভোগী কে? হত্যার পেছনে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনীতি থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনীতিই পাল্টে যায়। রাষ্ট্রের চরিত্রই পাল্টে দেয়া হয়। বাংলাদেশ পাকিস্তান হওয়ার পথে রওনা দিল। এজন্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে বহুমাত্রিক তদন্তের ব্যাপার রয়েছে। জিয়াউর রহমান মাঠপর্যায়ের নেপথ্যের নায়কদের প্রধান ছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কুশীলব ছিল পর্দার অন্তরালে। এদের খুঁজে বের করতে হবে। বৃহৎ শক্তির সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করতে যাদের বুক কাঁপবে না, তদন্ত কমিশনে তাদের রাখতে হবে।
গবেষক ও রাজনৈতিক ইতিহাসবেত্তা মহিউদ্দিন আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, কমিশন সরকার ও দলীয় লোকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে হতে হবে। নির্দলীয় লোকদের দিয়ে হতে হবে। এরপরও আশঙ্কা থাকে, দেশের সব কমিশনই তো তথাকথিত নির্দলীয় লোকদের দিয়ে। আমাদের দেশে কোনো কমিশনই নিরপেক্ষভাবে কাজ করে না। কমিশনগুলো সেটিই করে সরকার যা চায়। রাজনৈতিক সরকারের চাহিদা অনুযায়ী যদি কমিশন কাজ করে, তাহলে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সত্যিকার চিত্র কোনো দিনই বের হবে না। আমার আশঙ্কা, কোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে কোনো কমিশনই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে না। তিনি বলেন, কমিশন যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না হয়। এটি বড় চ্যালেঞ্জ। কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিতে হবে। কমিশনে অনুসন্ধানী গবেষকদের রাখা যেতে পারে। তবে দলীয় বিশেষজ্ঞদের নয়।