ডেস্ক নিউজ
যুক্তরাজ্যের রয়াল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস—রিবা অ্যাওয়ার্ড স্থাপত্যকলায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারগুলোর অন্যতম। আর ব্যবহার উপযোগিতা ও নান্দনিকতার জন্য সেই সম্মানজনক পুরস্কার জিতে নিল বিশিষ্ট স্থপতি কাশেফ চৌধুরীর নকশা করা বাংলাদেশের সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা শ্যামনগরের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। উপজেলা সদরের কাছে সোয়ালিয়া এলাকায় হাসপাতালটির অবস্থান।
২৫ জানুয়ারি শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের ভবনটিকে ২০২১ সালের রিবা অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক এ স্থাপত্য সংস্থাটির জুরি বোর্ড।
১৬ নভেম্বর ঘোষিত ২০২১ সালের রিবা অ্যাওয়ার্ডের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল ভবনটি। স্থপতি কাশেফ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান আরবানার তত্ত্বাবধানে তৈরি নকশা অনুসারে নির্মিত হয়েছে এটি। স্থপতি কাশেফ চৌধুরী এর আগে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
জার্মানির বার্লিনে ডেভিড চিপারফিল্ডের নকশা করা একটি গ্যালারি আর উইলকিনসন আইরের করা ডেনমার্কের একটি সাইকেল ও ফুটব্রিজকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে বাংলার নিভৃত কোণের এই প্রকৃতিসংলগ্ন স্থাপনা।
পুরস্কারের প্রতিক্রিয়ায় কাশেফ চৌধুরী যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি উত্ফুল্ল এটা ভেবে যে এ পুরস্কার আমাদের আরো অনেককে এ ধরনের স্থাপত্য গড়ে তুলতে উৎসাহিত করবে, যা মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ের কথা মাথায় রাখে। ’
জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ওডিল ডেক বলেন, ‘স্থাপনাটি মানবতা ও সুরক্ষার প্রতিচ্ছবি। এটি স্বাস্থ্যসেবার অসম সুযোগ ও অসহায় জনগোষ্ঠীর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের চরম প্রভাবের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গেও যুক্ত। ’
দক্ষিণ বাংলাদেশের জলাবদ্ধ ভূমিতে লালচে ইটের তৈরি ছিমছাম হাসপাতাল ভবনটি চারপাশের প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে গড়া। এর মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা খাল। ভবনটিকে বলা হয়েছে জলবায়ুসচেতন নকশার আদর্শ। ন্যূনতম উপকরণে নির্মিত হয়েছে এটি। পানি এ স্থাপনার একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। ভবনের মধ্যকার খালটিতে সঞ্চিত বৃষ্টির পানি প্রচণ্ড গরমের সময় চারপাশ শীতল রাখতে সহায়তা করে।
চারপাশের লবণাক্ত পানির দিকে ইঙ্গিত করে গার্ডিয়ানকে কাশেফ চৌধুরী আরো বলেন, ‘এখানে চারদিকে পানি। কিন্তু সব সময় তা ভালো পানি নয়। ’ এ কারণেই তিনি ভবনটির নকশা এমনভাবে করেছেন, যাতে তা বৃষ্টির পানি ধরে রাখারও এক ভাণ্ডারে পরিণত হয়। প্রতিটি অংশের ছাদ ও প্রাঙ্গণে পড়া সব বৃষ্টির ধারা গিয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় খালে। সেই পানি আবার জমা হয় স্থাপনাটির দুই পাশের দুটি জলাধারে। ভবনটির মধ্যে রাখা হয়েছে গ্রামীণ আবহ। প্রাঙ্গণজুড়ে কৌণিকভাবে স্থাপিত হয়েছে স্থাপনাগুলো। কাঠামোটি বৃষ্টির প্রবল ঝাপটা থেকে রক্ষার মতো করেই তৈরি। রয়েছে বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা। এর কাঠামোর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে দিনের বেলায় কোনো কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন হয় না।
শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালের ২২ জুলাই। নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে।
প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা উপকূলীয় মানুষকে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিয়েছে ৮০ শয্যার এই আরোগ্যালয়। শ্যামনগর উপজেলার জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাবিত লবণাক্ত এলাকায় এই হাসপাতালটি নির্মাণ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ। ছয়জন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স ও কয়েকজন সহকারী আছেন এতে। তিনটি অপারেশন থিয়েটারের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার হয় এখানে। প্রত্যন্ত এলাকা হলেও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ এবং অ্যাম্বুল্যান্স সুবিধা থাকায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগ খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা।
হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা, নির্বাহী পরিচালক প্যারিসে অবস্থানরত রুনা খান কালের কণ্ঠকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে স্থানীয় বিপন্ন মানুষের জন্য সাধ্যমতো সেরা সেবা দেওয়ার জন্য। চেয়েছিলাম এমন একজন স্থপতির সঙ্গে কাজ করতে, যিনি এটা উপলব্ধি করবেন। কাশেফ চৌধুরী আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। ’
স্থানীয়ভাবে হাসপাতালটির কার্যক্রম পরিচালনা ও দেখভাল করা মো. শাহীন আলম ও অসীম রোজারিও বলেন, ‘কাশেফ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করা ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। তিনি স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। পর্যাপ্ত আলো, বাতাস, মাটি, পানির সমন্বিত পরিবেশে শ্যামনগরের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সৌন্দর্য হয়ে উঠেছে আরো প্রাণবন্ত।