বিশ্বের দ্বিতীয় নিউজিয়াম গড়ে তুলেছেন বাংলার এক কৃষক। নাম তার আনোয়ার হোসেন আকন্দ। বিশ্বে প্রথম নিউজিয়ামটির অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউ আর কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউয়ের সংযোগস্থলে। আলোচিত ওই নিউজিয়াম গড়ে তুলতে খরচ হয়েছিল ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
নিউজিয়াম! মিলিয়ন ডলার খরচ! এসব শুনে কেউ ভিমরি খাবেন না। ভাববেন না মিউজিয়ামের ভুল উচ্চারণ। আর ক্যালকুলেটর নিয়ে মিলিয়ন ডলারের হিসেব কষতে বসবেন না কেউ। একটু খোলাসা করে বলি, নিউজিয়াম হচ্ছে নিউজ মিউজিয়াম। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় সংবাদ বা খবরের জাদুঘর। সংবাদপত্র, সংবাদ ও মিডিয়ার নানাধর্মী বিষয় ও উপাদান নিয়ে গঠিত মিউজিয়ামকেই নিউজিয়াম বলে। এই নিউজিয়াম সরকারি খরচে নয়, ব্যক্তি উদ্যোগে জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের আকন্দপাড়ায় গড়ে ওঠছে। নিউজিয়ামটি গড়ে তুলছেন কৃষক আনোয়ার হোসেন আকন্দ।
নিউজিয়ামে খ্যাতনামা ব্যক্তিদের জীবনী, ইতিহাস এবং প্রতিদিনের সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন ও ছবি সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনাবলি নিয়ে প্রকাশিত সংবাদপত্রের মূল কপিগুলো আছে এ সংগ্রহশালায়। সে সময় সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া বঙ্গবন্ধুর বেশকিছু দুর্লভ ছবিও সংরক্ষিত করা হয়েছে নিউজিয়ামে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ‘পাক জঙ্গিশাহীর জিন্দাখানা থেকে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধুর লন্ডন উপস্থিতি’, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘ফোন ধরে বেগম মুজিব প্রথমে কোনো কথাই বলতে পারেননি’। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশের শিরোনাম ছিল ‘এই মুহূর্তে আমি দেশবাসীর কাছে ফিরে যেতে চাই : বঙ্গবন্ধু’। এসব সংবাদপত্র আছে নিউজিয়ামে।
কৃষক আনোয়ার হোসেনের এই নিউজিয়ামে আরও আছে ১৯৪৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ এবং পূর্ববর্তী সময়ের পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ ক্লিপিংস। ১৮২৭ সালের মক্তব সাহিত্যের প্রথম ভাগ, ১৮৭৭ সালের শুভঙ্করী, ১৯৩৮ সালের ব্রিটিশ আমলের বই ‘পাঠান গৌরব’, ১৯০৬ সালের উপন্যাস ‘কাজী বাড়ীর পুকুর’। আছে বিজ্ঞান, বৃক্ষ, খেলাধুলা ও চিকিৎসা শাস্ত্রের বই। আছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ঘটনার সাত হাজারের বেশি ছবি। আছে বিচিত্রা, রোববার, ছুটি, মুসলিম জাহানসহ বিভিন্ন সাময়িকী। পত্রিকা কেটে যে বিষয়ভিত্তিক হাজার হাজার বই তৈরি করা যায়, তা দেখিয়েছেন আনোয়ার হোসেন আকন্দ। পত্রপত্রিকার পাতা কেটে সেগুলো নিজেই বাঁধাই করেন তিনি। কাঁচি, সুই-সুতা, আঠা সবই আছে তার। বিভিন্ন ম্যাগাজিনের পাতা কেটে বানিয়েছেন লাখ লাখ ক্লিপিং। তার
সংগ্রহ করা তথ্যভান্ডার এখন হয়ে উঠেছে তথ্যের এক বাতিঘর।
নিউজিয়াম জুড়ে আছে শত বছর আগের বিয়ের দাওয়াতপত্র, স্কুলের মানপত্র, নির্বাচনী প্রতীক, অফিসিয়াল চিঠি, মহাজনদের টালি খাতা, ব্র্রিটিশ রাজা-মহারাজাদের ফরমান, মেট্রিক পরীক্ষার সনদসহ আরও অনেক দুষ্প্রাপ্য দলিলপত্র। আছে পুরনো দিনের টর্চলাইট, কলম, ঘড়ি, ব্যাগ, তৈজসপত্র, থালা-বাসন, রেডিও, টেলিভিশনসহ অনেক কিছু।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীও আছে নিউজিয়ামে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, স্যার সলিমুলস্নাহ, শওকত আলী, তিতুমীর, এ পি জে আবদুল কালাম, মাও সে তুং, লেনিন, স্ট্যালিন, বাদশাহ খালেদ, মোহাম্মদ ওমর, মার্গারেট থ্যাচার, জিমি কার্টার, টনি বেস্নয়ার, বিল ক্লিনটন, জর্জ বুশ, আনোয়ার সাদাত, নেহরু প্রমুখের জীবনী আছে এখানে। রয়েছে নাটক, উপন্যাস, কাব্য, মহাকাব্য, ছোটগল্প, ক্লাসের পুরনো পাঠ্যবই, পঞ্জিকা ও ভিউকার্ড। প্রতিদিনই নিউজিয়াম দেখতে আসেন অনেকে, বই পড়ে সময় কাটান বয়স্করা। নিউজিয়ামের তথ্যভান্ডার থেকে তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে জ্ঞানার্জনে কাজে লাগাচ্ছেন সবাই। স্থানীয় লোকজনের কাছে আনোয়ার হোসেন দুর্গম অঞ্চলে এক আলোর দিশারি। নিউজিয়ামের বইপত্র মানুষকে পড়তে দেন। বই পড়ায় উৎসাহ দেন তরুণদের।
আনোয়ার হোসেন আকন্দ যায়যায়দিনকে বলেন, ‘আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এমন কিছু দৈনিক পত্রিকা রয়েছে, যেগুলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর খোঁজ করেও পায়নি। আমার নিউজিয়ামটি আগামী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের দলিল হিসেবে রেখে যেতে চাই। নানা সংকট ও বাধা অতিক্রম করে এ সংগ্রহশালাটি গড়ে তুলেছি। অবস্থা এমন হয়েছে যে, বাড়িতে এসব রাখার আর জায়গা নেই। আর্থিক সংকটের কারণে সংগ্রহশালাটি বড় করতে পারছি না, স্থায়ী একটি কাঠামোও তৈরি করতে পারছি না। এখন বয়স হয়েছে, শরীরে কুলায় না, তারপরও প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছি। আমার স্বপ্ন একটি স্থায়ী ভবনে নিউজিয়ামটি করা। যাতে দেশ-বিদেশের গবেষকরা এখানে গবেষণা করতে পারেন।
নিউজিয়ামের তথ্য সংগ্রাহক আনোয়ার হোসেন আকন্দের বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের গারো পাহাড়ের পাদদেশে নিভৃত গ্রাম আকন্দপাড়ায়। ১৯৫৫ সালের এক অক্টোবর তার জন্ম। ১৯৭৪ সালে তিনি ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এক পর্যায়ে তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যান। পরে আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। বাবা মৌলভী আতাউর রহমান আকন্দ কলকাতা বোর্ড থেকে আলিম পাস করে শিক্ষকতা করতেন স্থানীয় বিদ্যালয়ে। পাশাপাশি বিচিত্র ও বিরল বই-পুস্তক সংগ্রহ করে একটি ক্ষুদ্র সংগ্রহশালার সূচনা করেন। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় সংগ্রহশালাটি দেখভালের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। তখন থেকেই বইয়ের ছেঁড়া পাতা, কাগজের টুকরাগুলোকেও তিনি সংরক্ষণ করা শুরু করেন যত্নসহকারে।
সংগ্রাহক আনোয়ার হোসেনের শারীরিক ও আর্থিক দৈন্যদশায় ভুগছেন। বাবার রেখে যাওয়া সহায়-সম্পত্তি আর চাষাবাদ থেকে, যা আয় হয় তা দিয়েই জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেছেন। বয়সের ভারে শরীর নুয়ে পড়েছে। এমন অনটনেও সংসারের বাজারসদাই না এনে তিনি বাজার থেকে পত্রিকা নিয়ে খুশি মনে ঘরে ফেরেন। রাত জেগে কাটিং করেন গুরুত্বপূর্ণ খবর। এ কাজেই তার যত আনন্দ।