ডেস্ক নিউজ
- সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন জমা
- চলছে ডিজাইন প্রণয়ন
- সংযুক্ত থাকবে মেট্রোরেল, বিআরটি এবং ওয়াটারওয়ের সঙ্গে
- সম্ভাব্য কাজ শুরু ’২২ সালে
রাজধানীর যানজট নিরসনে এবার আসছে সার্কুলার ট্রেন। রাজধানীর চারপাশে মেট্রোরেলের আদলে স্ট্যান্ডার্টগেজ রেলপথে চলাচল করবে এই ট্রেন। ইতোমধ্যেই খসড়া সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। বিস্তারিত নক্সা প্রণয়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজধানীর চারপাশের এই রেললাইনের দৈর্ঘ্য হবে ৮১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৯.৯ কিলোমিটার হবে আন্ডারগ্রাউন্ড তথা মাটির নিচ দিয়ে। বাকি ৭০.৯৯ কিলোমিটার হবে এলিভেটেড। স্টেশনগুলোর মধ্যে ১২টি হবে ট্রান্সফার স্টেশন ও ১১টি ট্রানজিট স্টেশন। এ ট্রানজিট স্টেশনগুলো বিআরটি (বাস র্যাপিড ট্রানজিট) ও মেট্রোরেলের সঙ্গে যুক্ত করবে। সদরঘাটের স্টেশনটি যুক্ত করবে ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়ে তথা নৌপথকে। এসব ট্রানজিট ও ট্রান্সফার লাইনের মাধ্যমে নগরীর যেকোন স্থান থেকে যাত্রীদের এই সার্কুলার ট্রেনে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৩৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার যা বাংলাাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা। আধুনিক বিদ্যুতচালিত এসব ট্রেনের গতি হবে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। বিদ্যুতচালিত হওয়ায় এসব ট্রেনে হবেনা পরিবেশ দূষণ।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রাজধানীর পার্শ্ববর্তী টঙ্গী থেকে চালু হয়ে মোট ২৪টি স্টেশন ঘুরে পুনরায় টঙ্গীতেই গিয়ে থামবে এই ট্রেন। সার্কুলার এই রেলপথের ডিপো হবে ডেমরায় ও স্ট্যাবলিং ইয়ার্ড হবে আশুলিয়া বাইপাইল ত্রিমুখের কাছে। এছাড়া উত্তরা, কামরাঙ্গীরচর ও ডেমরায় হবে বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন। যেখান থেকে ট্রেনগুলো চলার জন্য বৈদ্যুতিক চার্জ গ্রহণ করবে। শুধু সড়কপথে নয় কম সময়ে ও কম খরচে রাজধানীর যে কোন প্রান্ত থেকে প্রবেশ করে আবার নিজের বাসস্থানে ট্রেনে চড়েই যাতে ফিরে যেতে পারেন সেজন্যই এমন উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। উন্নত বিশ্বের মতো শহরের অভ্যন্তরে চলাচলের জন্য শুধু সড়কপথ নয় রেলপথকেই প্রধান বাহন তৈরির অংশ হিসেবে এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি তৈরি করতে সরকারের মোট ২৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। স্টাডি অনুযায়ী আগামী ২০২২ সাল নাগাদ সরকার কাজ শুরু করলে ছয় বছর অর্থাৎ ২০২৮ সাল থেকেই নাগরিকগণ এর সুফল ভোগ করতে পারবেন। রাজধানী তথা দেশের অর্থনীতিতে গতি আনতে আশপাশে বসবাসরত নাগরিকদের চলাচল নির্বিঘœ করতেই বর্তমান সরকার এমন বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মূলত দেশের সকল নাগরিকের জন্য রাজধানীতে প্রবেশের পথ সুগম ও সহজলভ্য করতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে।
যানজটের কারণে সৃষ্ট মেগাসিটি ঢাকায় বসবাসরত ও আসা যাওয়া করা নাগরিকদের হাজার হাজার কোটি টাকার কর্মঘণ্টা প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে। যার প্রভাব সকল নাগরিকের ওপরই পড়ছে তাই যানজট থেকে নাগরিকদের স্থায়ীভাবে রক্ষা করতেই সরকার মেট্রোরেলের পাশপাশি সার্কুলার রেলপথ তৈরি করছে। এর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে বলে সরকারের বিশ্বাস। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর বিস্তারিত নক্সা প্রণয়নে কাজ এগিয়ে চলছে। সম্প্রতি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে সিউয়ান সার্ভে এ্যান্ড ডিজাইন গ্রুপ কোম্পানি। প্রতিবেদনে প্রকল্পটির রুট, সম্ভাব্য ব্যয় ও ভাড়া তুলে ধরা হয়।
বৃত্তাকার রেলপথটি টঙ্গী, আব্দুল্লাহপুর, ধউর, বিরুলিয়া, গাবতলী, রায়েরবাজার, বাবুবাজার, সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর, পোস্তগোলা, ফতুল্লা, চাষাঢ়া, সাইনবোর্ড, শিমরাইল, পূর্বাচল সড়ক, ত্রিমুখ হয়ে টঙ্গীতে পুনরায় যুক্ত হবে। সড়ক প্রশস্ত না থাকায় গাবতলী, সদরঘাট হয়ে পোস্তগোলা অংশ এবং কামরাঙ্গীরচর-শ্যামপুর অংশ আন্ডারগ্রাউন্ড হবে। অর্থাৎ কিছু অংশ মাটির নিচ দিয়ে নির্মিত হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ রেলপথের স্টেশনগুলো হবে টঙ্গী, বাইপাইল ত্রিমুখ, পূর্বাচল উত্তর, পূর্বাচল, বেরাইদ, ত্রিমোহনী, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, আদমজী, চিত্তরঞ্জন মোড়, চাষাঢ়া, ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগোলা, সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, ঢাকা চিড়িয়াখানা দক্ষিণ, চিড়িয়াখানা, উত্তরা, ধউর ও বিশ্ব ইজতেমা মাঠ। এর মধ্যে সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর ও সিদ্ধিরগঞ্জ স্টেশন তিনটি হবে আন্ডারগ্রাউন্ড।
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে বৃত্তাকার রেলপথে সম্ভাব্য দৈনিক যাত্রী প্রক্ষেপণ। এতে বলা হয়, ২০৩৫ সালে এ রেলপথে দৈনিক যাত্রী হবে ১০ লাখ ৬৫ হাজার ও ২০৫৫ সালে তা বেড়ে দাড়াবে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার। রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয় হবে ৪০৬ কোটি ৯২ লাখ ডলার। এর মধ্যে স্টেশন নির্মাণে ৪৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলার, রেলপথ নির্মাণে ২৪১ কোটি পাঁচ লাখ, ট্র্যাক নির্মাণে ২১ কোটি ২৯ লাখ, টেলিকমিউনিকেশনে আট কোটি ৯০ লাখ, সিগনালে ১৩ কেটি ৩২ লাখ, পাওয়ার সরবরাহে ৩৯ কোটি ৯৯ লাখ, যাত্রী ফেসিলিটি ও প্ল্যাটফর্ম নির্মাণে সাত কোটি ৭৭ লাখ, ডিপো নির্মাণে ১৯ কোটি ১২ লাখ ডলার উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বাকি অর্থ অন্যান্য নির্মাণ খাতে ব্যয় করা হবে।
এছাড়া এর বাইরে জমি অধিগ্রহণ ও অন্যান্য খরচ ১২৯ কোটি ৩২ লাখ ডলার, কনটিনজেন্সি (ব্যয় ও ভৌত সমন্বয়) ১৬৪ কোটি ডলার এবং রোলিং স্টক ও অন্যান্য ফি বাবদ ১৩৭ কোটি ডলার। এদিকে বৃত্তাকার রেলপথ পরিচালনায় ২০৩৫ সালে খরচ হবে ৫১ কোটি ৪৭ লাখ ডলার ও ২০৫৫ সালে তা কমে দাঁড়াবে ৩৫ কোটি আট লাখ ডলার। বৃত্তাকার রেলপথে বিনিয়োগের জন্য বিল্ড ওন ট্রান্সফার (বিওটি) অথবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ায় এক্ষেত্রে ভিত্তি ভাড়া ধরা হয়েছে ৩০ টাকা ৬০ পয়সা। এই অর্থ নিয়ে যাত্রীদের থেকে নির্মাণ ব্যয় তোলা হবে। এর সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া যুক্ত হবে ৩ টাকা ৮০ পয়সা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক মনিরুল ইসলাম ফিরোজী জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে সরকারের মাস র্যাপিড ট্রানজিট, বিআরটিসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চলমান প্রকল্পগুলো ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে পুরো ঢাকাকে ঘিরে কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। ফলে ঢাকার বাইরের মানুষজন প্রয়োজন না থাকলেও বাধ্য হয়ে ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করতে হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়তই সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট। এর কারণে নাগরিকদের প্রতিদিনই লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। এজন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় ঢাকার আশপাশের যেকোন স্থান থেকে ঢাকায় প্রবেশ করতে পারে বা ভেতরে প্রবেশ না করেই যাতে করো কোন নাগরিক কাজ শেষ করে ঢাকার বাইরে থেকেই বাড়িতে ফিরতে পারেন সেজন্য দুধরনের ব্যবস্থা চালু করতে উদ্যোগ নিয়েছে। সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে এই প্রকল্পের জন্য একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে। কোন কোন পথে রেলপথটি চলাচল করবে, কোন স্থানে স্টেশন নির্মাণ করা যেতে পারে ও কবে নাগাদ এর কাজ শুরু করলে তা শেষ করে নাগরিকদের কাজে লাগানো সম্ভব হবে তা প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। গত বছরের নবেম্বরে এটি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।
মনিরুল ইসলাম ফিরোজী বলেন, এ রেলপথটি পরিচালিত হবে শতভাগ বৈদ্যুতিক সিস্টেমে এসব ট্রেনের গতি হবে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত। মাটির নিচে ওপরে ২ স্থানেই এর মোট ২৪টি স্টেশন নির্মাণ করতে হবে। একইসঙ্গে বৈদ্যুতিক চার্জ স্টেশন নির্মাণ ও ট্রেনের ডিপো তৈরি করা হবে। অপরদিকে এই সার্কুলার রেল চালু করা গেলে উন্নত বিশ্বের মতো রাজধানীর সৌন্দর্যও অনেকাংশেই বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের হবে ফলে দেশের অর্থনীতিতেও গতি বাড়বে। রিপোর্ট অনুযায়ী সরকার এ সম্পর্কিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবেন কি না, করলে এর সুফল কতটুকু তার ওপর ভিত্তি করে সার্কুলার রেল নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করে নির্মাণ কাজ শুরু করবে। স্টাডি তৈরি করতে সরকারের মোট ২৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। স্টাডি অনুযায়ী আগামী ২০২২ সাল নাগাদ সরকার কাজ শুরু হবে। ৬ বছরে অর্থাৎ ২০২৮ সাল থেকেই নাগরিকগণ এর সুফল ভোগ করতে পারবেন। এটি চালু করা গেলে দেশে রেলপথে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।