ডেস্ক নিউজ
বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বিদায়ি বছরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সমুজ্জ্বল ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মহামারি করোনা মোকাবিলা করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হয়েছেন তিনি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারে আন্তর্জাতিক পদক নিজের ঝুলিতে নিয়েছেন। ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায়ও।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তর করার অঙ্গীকার করেছিলেন। কোভিড-১৯ মহামারির ভয়াবহতম সময়েও সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি বাংলাদেশের এই অদম্য অগ্রযাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গেল বছরের ২৩ নভেম্বর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অনুমোদন করেছে। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে নিজের স্বপ্নপূরণে আরও এগিয়ে যান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আরও পরিলক্ষিত হয়েছে বিদায়ি বছরে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক আয়োজন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে। পৃথিবীর সব বড় বড় দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রশংসাসূচক শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন। আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রধানরা করোনার ঝুঁকি নিয়েও বাংলাদেশে এসেছেন।
দীর্ঘদিন ঘরোয়াভাবে কর্মসূচির পর মহামারি কিছুটা নিস্তেজ হওয়ায় গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সরাসরি অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তী সময়ে লন্ডন ও ফ্রান্সে পৃথক বিষয়ে সম্মেলনে অংশ নেন। বছরের একেবারে শেষ দিকে মালদ্বীপ সফর করেন। এসব সফরে জোরালো ভাষায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও রোহিঙ্গা সঙ্কট ইস্যুতে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি বাংলাদেশে ফিরিয়েছেন।
এবার জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর সম্মানে জাতিসংঘ সদর দফতরের উত্তর লনের বাগানে একটি বেঞ্চ উৎসর্গের পাশাপাশি একটি বৃক্ষরোপণ করে বাংলাদেশকে আরও উচ্চ আসনে আসীন করেছেন।
নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের রাজধানী গ্লাসগোয় ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে (কপ-২৬) জলবায়ু বিপর্যয় রোধে চার দফা প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী। এবারের সম্মেলনে তার নেতৃত্ব ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর পক্ষে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা সবার নজর কেড়েছে। কপ-২৬ জলবায়ু আলোচনা এগিয়ে নিতে প্রভাব রাখছেন এমন পাঁচ প্রভাবশালী আলোচকের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুভাষার সংবাদমাধ্যম বিবিসি। এ তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ডিসেম্বরে মালদ্বীপে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মালদ্বীপকে ঘিরে আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার এ সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্লেষকরা বর্ণনা করেছেন। এই সফরে দুদেশের মধ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দ্বৈত করারোপ, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়।
এ ছাড়া করোনা মহামারি মোকাবিলায় দেশব্যাপী গণটিকাদান কর্মসূচি, করোনার মধ্যেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনসহ নানা অর্জন ও উদ্যোগের কারণে তিনি বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পেয়েছেন।
পুরস্কার : জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের কারণে ‘এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার’ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দারিদ্র্য দূরীকরণ, বিশ্বের সুরক্ষা এবং সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের সার্বজনীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) পুরস্কারটি দেয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন কৌশলবিদ অধ্যাপক জেফরি ডি স্যাকসের নেতৃত্বে জাতিসংঘ মহাসচিবের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সালে এসডিএসএন প্রতিষ্ঠা করা হয়। শেখ হাসিনাকে ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন অব দ্য ডে’ হিসেবে তুলে ধরেন পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জেফরি স্যাকস।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে নেতৃত্বদান এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীকে ‘উইটসা এমিনেন্ট পারসনস অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ পদক দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের ৮০টি দেশের সদস্যভুক্ত সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সার্ভিসেস অ্যালায়েন্স’ তথ্যপ্রযুক্তির অলিম্পিক খ্যাত এ ‘উইটসা ২০২১’ পুরস্কার প্রদান করে।
করোনা মোকাবিলায় সাফল্য : করোনাকালে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রেখে বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষে উঠে আসে বাংলাদেশ। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা, টিকাদান কর্মসূচি এবং সামাজিক গতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে বৈশ্বিক এই সূচক করে জাপানের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক নিক্কি এশিয়া।
বিশ্বের ১২১টি দেশ ও অঞ্চলের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পর্যালোচনার পর চারটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে এই সূচক তৈরি করা হয়। এতে দেশগুলোর প্রাপ্ত স্কোর ০ থেকে ৯০-এর মধ্যে। কোভিড-১৯ মোকাবিলার সূচক অনুযায়ী আগেরবারের তুলনায় এবার বাংলাদেশের ৪৮ ধাপ উন্নতি হয়। ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ২৬তম স্থানে অবস্থান করে। বাংলাদেশ ৯০ স্কোরের মধ্যে ৬০ পেয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে।
করোনার কারণে ২০২১ সালে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। স্থবির হয়ে গিয়েছিল অর্থনীতির চাকা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশে অর্থনীতির চাকা মহামারির চরম স্থবিরতার মধ্যেও সচল থেকেছে। যদিও গতি খানিকটা কমে গিয়েছিল।
বিশ্বব্যাংক মনে করছে, পরের অর্থবছরে বাংলাদেশে আরও বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। কোভিড-১৯-এর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার মোট ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। এ সময় চাকরিহীনদের হাতে হাতে টাকা পৌঁছে দিয়েছে সরকার। যার ফলে কাউকে অতিদরিদ্র হতে হয়নি।
বিনা মূল্যে করোনার টিকা : ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তার পরপরই পুরো বিশ্ব অচল হয়ে যায় করোনার ভয়াল থাবায়। বন্ধ হয়ে যায় দেশে দেশে যাতায়াত। এমনকি প্রায় সব দেশের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আশার আলো জাগায় করোনার টিকা। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেশের মানুষ বিনামূল্যে টিকা পাবে। বিশ্বের প্রথম ২৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, যারা গণটিকা দিয়েছে দেশের মানুষদের। করোনার টিকা কেনার জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দ রাখার নির্দেশ ছিল প্রধানমন্ত্রীর। করোনার নতুন ধাক্কার কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আবার চালু হয়েছে করোনার বুস্টার ডোজ।
আবারও ফোর্বসের প্রভাবশালীর তালিকায় : যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাময়িকী ফোর্বস বিদায়ি বছর ২০২১ সালে বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে ৪৩তম স্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২০ সালেও প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেবারের তালিকায় তিনি ছিলেন ৩৯তম অবস্থানে।
এবারও তালিকায় স্থান পাওয়া শেখ হাসিনা সম্পর্কে তার প্রোফাইলে লেখা হয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। এবার চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকারের দায়িত্ব নেয় তার দল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, তার পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। শেখ হাসিনার সংগ্রাম দেশে দৃঢ় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে বলেও মন্তব্য করা হয়।