ডেস্ক নিউজ
অবশেষে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত কর্মচারীদের পদোন্নতি, বেতনস্কেল উন্নীতকরণ এবং নতুন পদ সৃষ্টি হচ্ছে। দুই দশকের বেশি সময়ের দাবি ও আন্দোলনের মুখে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নতুন পদ সৃষ্টি, পদোন্নতি ও বেতনস্কেল উন্নীতকরণের সারসংক্ষেপ ইতোমধ্যে অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে ১৩-১৫তম গ্রেডের কর্মচারীদের পদবি পরিবর্তন ও বেতনস্কেল উন্নীত হচ্ছে। এ ছাড়া বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলায় কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদের বেতন স্কেল ১১তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেডে উন্নীত করা হবে। খুব শিগগিরই কর্মচারীরা এ সুখবর পেতে যাচ্ছেন। তবে নিয়োগবিধি পরিবর্তন করে ১৬-২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের পদবি পরিবর্তন ও বেতনস্কেল উন্নীত না হলে ফের আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন বাংলাদেশ কালেক্টরেট সহকারী সমিতির (বাকাসাস) নেতারা। বিশ্বস্ত সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
সরকারি কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া পর্যালোচনা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. জাফর ইকবাল এ প্রসঙ্গে আমাদের সময়কে বলেন, আমরা কর্মচারীদের দাবি নিয়েই সভা করেছি। দীর্ঘ সময় ধরে অনুষ্ঠিত পর পর দুটি সভায় তাদের দাবি-দাওয়া পর্যালোচনা করা হয়েছে। আশা করছি তারা সুখবর পাবেন। কাউকেই হতাশ করতে চাই না।
সূত্র বলছে, ৮ বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে ৮টি শাখা কর্মকর্তা বা সেকশন অফিসারের (গ্রেড-৯) পদ সৃষ্টি হচ্ছে। এ পদের কর্মকর্তারা ৯ম গ্রেডে বেতন-ভাতা পান। বিশেষ ক্যাটাগরিতে (ক) ৬ জেলার প্রতি জেলায় ৩টি করে ১৮টি মোট শাখা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি হচ্ছে। খ. ক্যাটাগরির ২৬ জেলার প্রতি জেলায় ২টি করে ৫২, গ. ক্যাটাগরির ৬ জেলার প্রতি জেলায় ১টি করে ৬টি এবং ৬৪ জেলার সদর উপজেলায় ১টি করে ৬৪টিসহ সর্বমোট ২১৮টি শাখা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি হচ্ছে। খুব শিগগিরই এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া প্রশাসনিক কর্মকর্তার (্এও) পদ সৃষ্টি হচ্ছে ৪৭০টি। বর্তমানে মাঠ প্রশাসনের কার্যালয়গুলোয় এও পদ আছে মাত্র ৮৩টি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৩-১৫তম গ্রেডের কর্মচারীদের অর্থাৎ অফিস সহকারী কাম উচ্চমান সহকারী (গ্রেড-১৩), সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর (গ্রেড-১৩), প্রধান সহকারী (গ্রেড-১৪), ট্রেজারি হিসাবরক্ষক (গ্রেড-১৪), সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর (গ্রেড-১৪), পরিসংখ্যান সহকারী (গ্রেড-১৪) এবং উচ্চমান সহকারী (গ্রেড-১৫) পদধারীদের পদ পরিবর্তন করে সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা (গ্রেড-১৩) করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রধান সহকারী (গ্রেড-১৪), ট্রেজারি হিসাবরক্ষক (গ্রেড-১৪), সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর (গ্রেড-১৪), পরিসংখ্যান সহকারী (গ্রেড-১৪) এবং উচ্চমান সহকারী (গ্রেড-১৫) পদগুলোর বেতনস্কেল ১৩তম গ্রেডে উন্নীত হচ্ছে। এ ছাড়া উপজেলা কার্যালয়ে কর্মরত সিএ কাম উচ্চমান সহকারী (গ্রেড-১৩), সাঁটলিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর (গ্রেড-১৩), প্রধান সহকারী (গ্রেড-১৪), সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর (গ্রেড-১৪) এবং উচ্চমান সহকারী (গ্রেড-১৫) পদগুলোর নাম পরিবর্তন করে ১৩তম গ্রেড বেতনস্কেলে সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা করা হচ্ছে। পুরো দেশে এসব পদে ২ হাজারের বেশি কর্মচারী চাকরি করছেন। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সুফল পেতে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু ১৬-২০তম গ্রেডে কর্মরত কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদের কর্মচারীদের পদ পরিবর্তনের বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত। নিয়োগবিধি পরিবর্তন করে তাদের পদবি পরিবর্তন অর্থাৎ কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক এবং অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদটি অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে পরিবর্তন করলেই তারা সুফল পাবেন। নিয়োগবিধি সংশোধন কিংবা পরিবর্তন না করলে আন্দোলনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন তারা। এসব পদে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কর্মচারী চাকরি করছেন। শেষ পর্যন্ত এই কর্মচারীর দাবি আদায় অর্থাৎ পদবি পরিবর্তন ও বেতনস্কেল উন্নীত না হলে তারা ফের আন্দোলনে যাবেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ কালেক্টরেট সহকারী সমিতি (বাকাসাস)।
এ প্রসঙ্গে বাকাসাসের সভাপতি আকবর আলী আমাদের সময়কে বলেন, আমরা প্রায় দুই দশক ধরে পদবি পরিবর্তন ও বেতনস্কেল উন্নীত করার দাবি জানিয়ে আসছি। সম্প্রতি আমরা কর্মবিরতিও পালন করেছি। এক পর্যায়ে জনপ্রশাসন সচিব আশ^াস দিয়েছেন আমাদের দাবি পূরণ করবেন। দাবি-দাওয়ার সারসংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদনও দিয়েছেন। জনপ্রশাসন এই নিয়ে কাজ করছে বলে জেনেছি। তবে নিয়োগবিধি সংশোধন না করলে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকরা কোনো সুবিধাই পাবে না।
বাকাসাসের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নেছার আহমদ আমাদের সময়কে বলেন, মূলত যে দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছি তা পূরণ হচ্ছে না। যারা আগেই পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের পুনরায় পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ বঞ্চিতরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। নিয়োগবিধি সংশোধনপূর্বক আমাদের সাড়ে ৮ হাজার কর্মচারীর পদবি ও বেতনস্কেল পরিবর্তন করতেই হবে। সরকারের সিদ্ধান্ত দেখার পর আমরা পুনরায় আন্দোলনের বিষয়ে চিন্তা করব। সরকারের শীর্ষ মহলের প্রতি দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অবশ্য নিচের দিকের কর্মচারীদের দাবি অর্থাৎ পদ আপগ্রেড করতে হবে।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. আলি কদর আমাদের সময়কে বলেন, মাঠ প্রশাসনে নতুন পদ সৃষ্টি ও বেতনস্কেল পরিবর্তনের কাজ চলছে। এখানে অর্থ বিভাগের অনুমোদনের বিষয় আছে। সরকারি কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া পর্যালোচনা সংক্রান্ত কমিটি আছে, সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই কর্মচারীদের দাবি পূরণ হবে।
প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর করা সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাঠ প্রশাসনে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সরকারের নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সমন্বয়সহ মাঠ প্রশাসনের যাবতীয় কার্যক্রম বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। এসব কার্যালয়ে কর্মরতরা উল্লিখিত কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগী হিসেবে দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন করেন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের পর ভিন্ন ভিন্ন পেক্ষাপটে সচিবালয় এবং সরকারের অনেক দপ্তরের কর্মচারীদের পদ পরিবর্তন, বেতনস্কেল উন্নীতকরণ ও পদোন্নতির বিধিমালা যুগোপযোগী করা হলেও মাঠ প্রশাসনের কার্যালয়গুলোর কর্মচারীদের পদবি পরিবর্তন, বেতনস্কেল উন্নীত করা হয়নি। এ অবস্থায় ২০১৮ সালের ২৩ এপ্রিল প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে কর্মচারীদের পদবি পরিবর্তন, বেতনস্কেল উন্নীতকরণসহ নিয়োগবিধি সংশোধন বা নতুন করে প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়। ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে মাঠ প্রশাসনের কর্মরত তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন গ্রেড অনুযায়ী পদের নাম পরিবর্তন এবং সচিবালয়ের কর্মচারীদের মতো পর্যায়ক্রমে পদোন্নতির জন্য নিয়োগবিধি তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।
দাবি আদায়ে সোচ্চার সচিবালয়ের এও-পিওরা : সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা (্এও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা (পিও) ১০ম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেডে যেতে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও আছে বলে দাবি তাদের। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা তাদের দাবি বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে। এও-পিওদের দাবি বাস্তবায়ন হবে কিনা তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে দাবি আদায়ে অনড় রয়েছে তারা। গত ২৬ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের করিডোরে কয়েকশ কর্মকর্তা-কর্মচারী বড় ধরনের শোডাউন করেন। সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সংগঠনের সিনিয়র নেতারা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. আলি কদর এবং জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের একান্ত সচিব মো. রেজাউল আলমের সঙ্গে মতবিনিয়ম করেন।
মতবিনিময় শেষে তারা প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, কর্মচারীদের ৯ দফা দাবি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনায় নিয়ে মন্ত্রণালয় পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
দাবি আদায়ে অনড় ডাক অধিদপ্তরের কর্মচারীরা : পদবি বৈষম্য নিরসনে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলনে রয়েছেন ডাক অধিদপ্তরের কয়েক হাজার কর্মচারী। তাদের দাবি, সচিবালয়, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, হাইকোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রধান সহকারী, সহকারী, উচ্চমান সহকারী পদগুলোকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তিনবার সুপারিশের পরও অন্য সরকারি দপ্তর ও সংস্থায় কর্মরত বর্ণিত পদগুলো আগের পদবি ও বেতন স্কেলেই রাখা হয়েছে। এ বৈষম্য দূর করার দাবি জানান তারা।