ডেস্ক নিউজ
করোনাভাইরাসের চলমান টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের প্রায় ১৪ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। গতকাল শনিবার পর্যন্ত প্রায় ২১ লাখ বা এক শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত টিকাদানে বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। দেশটির এক শতাংশের কম মানুষ এ পর্যন্ত টিকাদানের আওতায় এসেছে। শুধু ভারত নয়, টিকাদানে জাপান, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। তবে টিকাদানে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে সফল দেশ ইসরায়েল। দেশটির ৮২ শতাংশের ওপরে মানুষ এরইমধ্যে টিকা পেয়ে গেছেন।
টিকাদান কর্মসূচির বৈশ্বিক তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করছে আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা নামে একটি ওয়েবসাইট। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিশ্বের মোট ২০ কোটি ৮ লাখ ৮৪ হাজার ৫৬৪ জন মানুষকে টিকার প্রথম ডোজের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এই হার বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই দশমিক ৫৭ শতাংশ। একইসঙ্গে ৬১ দেশে দ্বিতীয় ডোজের আওতায় এসেছে ৩ কোটি ৫৭ লাখ ৮০ হাজার ৬৪ জন মানুষ। মোট জনসংখ্যার বিপরীতে এই হার শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। ওয়েবসাইটটির তথ্য অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশ টিকাদানে বিশ্বে ২২তম স্থানে রয়েছে। আর টিকাদানের ডোজ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম। এর আগে বিশ্বের ৫৪তম দেশ হিসেবে গত ২৭ জানুয়ারি টিকাদান কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ। তবে গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হয় গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে। গতকাল ছিল টিকাদান কর্মসূচির ১২তম দিন। এদিকে, জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গতকাল পর্যন্ত বিশ্বের ৮৭ দেশে টিকার প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। অপরদিকে বার্তা সংস্থা এপির খবরে বলা হয়, বিশ্বের ১০৭টি দেশে টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
গণটিকাদান কর্মসূচির শুরুর মাত্র ১২ দিনের মাথায় এক শতাংশের বেশি মানুষ টিকার আওতায় আনার ঘটনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, শুরুতে টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। আবার টিকা আসার পর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা গুজব চালানো হয়। এ কারণে টিকা গ্রহণে মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়। তবে সব শঙ্কা কাটিয়ে টিকাগ্রহণে মানুষের স্বতঃস্ম্ফূর্ত সাড়া মিলেছে।
জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির কোর কমিটির সদস্য ও আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, প্রথম মাসে ৩৫ লাখ মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এখন সেটার পরিবর্তন এনে প্রথম মাসে ৬০ লাখ মানুষকে টিকাদানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১২ দিনে প্রায় ২১ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন। পরবর্তী ১৫ দিনে আরও ৪০ লাখ মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা নামে ওই ওয়েবসাইটের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, টিকাদান কর্মসূচিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল ইসরায়েল। দেশটির ৮২ দশমিক ৪ শতাংশ টিকার আওতায় এসেছে। এরপর পর্যায়ক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত ৫৫ দশমিক ২৭, সার্বিয়া ২৬ দশমিক ৫৩, যুক্তরাজ্য ২৫ দশমিক ৭৩, যুক্তরাষ্ট্র ১৭ দশমিক ৮২, বাহরাইন ১৫ দশমিক ৭৭, চিলি ১২ দশমিক ৪৩, ডেনমার্ক ৭ দশমিক ৯২, তুরস্ক ৭ দশমিক ৫৪, সুইজারল্যান্ড ৭ দশমিক শূন্য ৭, রোমানিয়া ৬ দশমিক ৮৫, পোল্যান্ড ৬ দশমিক ৭৬, মরক্কো ৬ দশমিক ৪, স্পেন ৬ দশমিক ২৮, জার্মানি ৫ দশমিক ৬৩, ইতালি ৫ দশমিক ৬, ফ্রান্স ৫ দশমিক ১৮, কানাডা ৩ দশমিক ৭২, ব্রাজিল ৩ দশমিক শূন্য ৭, চীন ২ দশমিক ৮২ এবং রাশিয়া ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পেরেছে। ৭ ফেব্রুয়ারি গণটিকাদান শুরু করা বাংলাদেশ ১ দশমিক ১২ শতাংশ মানুষকে ইতোমধ্যে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের তুলনায় সংখ্যার হিসাবে পাঁচগুণ টিকা বেশি দিলেও প্রতিবেশী ভারত শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পেরেছে। এশিয়ার অন্য তিন দেশ পাকিস্তান শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, নেপাল শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কা শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে সমর্থ হয়েছে।
ওয়েবসাইটটির তথ্য বলছে, গত শুক্রবার পর্যন্ত বিশ্বের মধ্যে টিকাদানে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম। যুক্তরাষ্ট্রে ৫ কোটি ৯৫ লাখ ৯০ হাজার ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। চীনে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ কোটি ৫ লাখ ২০ হাজার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২ কোটি ৫৪ লাখ ৬০ হাজার, যুক্তরাজ্য ১ কোটি ৭৪ লাখ ৭০ হাজার, ভারত ১ কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার, ইসরায়েল ৭১ লাখ ৩০ হাজার, ব্রাজিল ৬৫ লাখ ৪০ হাজার, তুরস্ক ৬৩ লাখ ৬০ হাজার, সংযুক্ত আরব-আমিরাত ৫৪ লাখ ৭ হাজার, জার্মানি ৪৭ লাখ ২০ হাজার, রাশিয়া ৩৯ লাখ, ফ্রান্স ৩৫ লাখ ১০ হাজার, ইতালি ৩৩ লাখ ৯০ হাজার, স্পেন ২৯ লাখ ৪০ হাজার, পোল্যান্ড ২৫ লাখ ৬০ হাজার, চিলি ২৩ লাখ ৮০ হাজার, মরক্কো ২৩ লাখ ৬০ হাজার এবং বাংলাদেশ ২০ লাখ ৩৪ হাজার ৫৬৪ ডোজ টিকা দিয়েছে। বাংলাদেশের পরে ইন্দোনেশিয়া ১৭ লাখ ৯০ হাজার ডোজ নিয়ে ১৯তম স্থানে এবং ১৪ লাখ ডোজ টিকাদান করে কানাডা ২০তম স্থানে অবস্থান করছে। তবে এশিয়ার দেশ জাপানে ৪৮৬ জন, ইরানে ১০ হাজার, নেপালে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮৭, শ্রীলঙ্কা ১ লাখ ৯৬ হাজার ১৬৩, মালদ্বীপ ৫০ হাজার ৪৭ এবং পাকিস্তানে ৫২ হাজার ৭৬৮ জন টিকার আওতায় এসেছে।
টিকার পরও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে- মত বিশেষজ্ঞদের :টিকা গ্রহণের পরও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, টিকাদানের র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ যে অবস্থানে রয়েছে, সেটি সন্তোষজনক। কর্মসূচি শুরুর পর এতো অল্প সময়ে এক শতাংশের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ভীতি কাটিয়ে মানুষ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে টিকা নিচ্ছে। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ টিকা কিনেছে। অথচ তাদের তুলনায় টিকাদানে আমরা এগিয়ে আছি। টিকা নেওয়ার এই গতিটা ধরে রাখতে হবে। একইসঙ্গে মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে মানুষকে সচেতন করতে হবে। অন্যথায় টিকাদান কর্মসূচি সফল হবে না।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার গত এক মাসের বেশি সময় ধরে ৫ শতাংশের নিচে আছে। এর মানে এই নয় যে সংক্রমণ কমে গেছে। বিশ্বের অনেক দেশেই সংক্রমণের হার কমার পর আবারও বেড়েছে। তাই ঢিলেমি দিলে চলবে না। মনে রাখতে হবে টিকা মৃত্যু কমাবে। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা একটি অন্যতম পন্থা। তবে একমাত্র পন্থা নয়। টিকা নেওয়ার পাশাপাশি মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য :সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি টিকাদান কর্মসূচিতেও সাফল্য এসেছে। মাত্র ১২ দিনে প্রায় ২১ লাখ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। এটি ইতিবাচক। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে সৃষ্ট গুজবের কারণে শুরু দিকে মানুষের মধ্যে ভীতি কাজ করেছিল। তবে টিকা গ্রহণকারী সবাই সুস্থ থাকায় মানুষের ভয় কেটে গেছে। এরপর টিকাদান কর্মসূচিতে স্বতঃস্ম্ফূর্ত সাড়া মিলেছে।
দেশে টিকার কোনো সংকট হবে না উল্লেখ করে জাহিদ মালেক বলেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে কেনা টিকার তিন কোটি ডোজের পাশাপাশি কোভ্যাক্স থেকে টিকা আসবে। আগে কোভ্যাক্স থেকে ২০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এই হার ২৭ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। চলতি বছরজুড়ে এই টিকা আসতে থাকবে। একইসঙ্গে বিতরণ কার্যক্রমও চলবে। এরপর প্রয়োজন হলে আরও টিকার ব্যবস্থা করা হবে।