ভাসানচর শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়ণের মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ থাকছে না। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের এই দ্বীপে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভাসানচরে পশুপাখির অভয়ারণ্যসহ ইকো-ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন প্রকল্প সংশ্নিষ্টরা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে নৌবাহিনী। শিগগিরই বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের একটি কমিটি দ্বীপটি পরিদর্শনে যাবে।
স্নিগ্ধ-সবুজ ভাসানচরকে নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন পর্যটন সংশ্নিষ্টরা। তারা বলছেন, প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের জন্য ভ্রমণপিপাসুদের কাছে পছন্দের আরেক নাম হতে পারে ভাসানচর। সমুদ্রকে ঘিরে যারা প্রকৃতির কোলে কিছুটা সময় কাটাতে চান, তারা এই দ্বীপে পাবেন নতুন অভিজ্ঞতা। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ায় বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপ ভাসানচরে নৌযানে যেতে লাগে আধাঘণ্টার মতো সময়। নোয়াখালীর চেয়ারম্যানঘাট থেকে হাতিয়া হয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ণ প্রকল্প ভাসানচরে যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। আর চট্টগ্রাম থেকে সাগর পাড়ি দিতে লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। চট্টগ্রাম কিংবা নোয়াখালীর সব পথেই অভিযাত্রা হবে রোমাঞ্চকর। সমুদ্রের জলরাশি পাড়ি দিতে দিতে উপভোগ করা যাবে প্রকৃতির অনবদ্য সুষমা। ভাসানচরে পা রাখতেই মিলবে প্রাণের ছন্দ। আশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরির পরও সবুজ এই দ্বীপের বড় অংশই খালি পড়ে আছে। ১৩ হাজার একর আয়তনের বিস্তীর্ণ এই দ্বীপের মাত্র ৪৩২ একর খরচ হয়েছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পে। পুরো দ্বীপের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে প্রকৃতির অলংকার। শিহরণ জাগায় সবুজের রোমাঞ্চ। পাখির কলরবে এখানে ভোর হয়। পাখির অবিরাম আলাপন জুড়ে থাকে সারাবেলা। সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে চরের জমিন। শ্বাসমূল, কেওড়াসহ নানা প্রজাতির গাছগাছালিতে অদ্ভুত প্রকৃতির রূপ। সাতসকালেই চোখ জুড়াবে আবহমান গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য পোষা প্রাণীর বিচরণে। কেউ মিতালি করে খাল আর লেকের পানিতে, কেউবা নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় সুরে সুরে। খাল-বিল-লেকে হরেক রকম মাছের আনাগোনা। অথৈ জলের মাঝে দ্বীপের উর্বর পলিতে সোনা ফলে।
দ্বীপের তীরে বসে বিশাল সাগরের ঢেউ যেমন উপভোগ করা যায়। তেমনি দেখা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। যেখান চাঁদ আর সূর্যের অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায় একই সময়ে একই জায়গা থেকে। পূর্ণিমার চাদের আলোয় ভেসে যায় ভাসানচর।
হাতিয়া দ্বীপের সাংবাদিক ইসমাইল হোসেন কিরণ সমকালকে বলেন, চর শব্দটি শুনলে মানসপটে যে রুক্ষ রূপ ভেসে ওঠে, ভাসানচর তার বিপরীত। পলিমাটিবেষ্টিত এই উর্বর ভূমিকে তাই বনাঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৩ সালেই। একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে লাখ-লাখ ম্যানগ্রোভ, আর মাঝখানে লেক। ম্যানগ্রোভ বনে প্রাণীদের অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে পারলে পর্যটন খাতের বিকাশ ঘটবে এবং জীববৈচিত্র্যও রক্ষা পাবে।
ভাসানচরে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা পালস বাংলাদেশ সোসাইটির সহকারী প্রকল্প সমন্বয়ক তুহিন সেন সমকালকে বলেন, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী এখানে বসবাস করবে। তাদের সেবা দিতে আগমন ঘটবে দেশি-বিদেশি বহু এনজিও কর্মীর। তাদের মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে এই দ্বীপের সৌন্দর্য। মানুষ প্রকৃতির কাছে যাওয়ার জন্য যা চায়, তার সবই ভাসানচরে আছে।
এদিকে শুধু রোহিঙ্গাদের নতুন আবাস নয়, ভাসানচর গত কয়েক বছরে সন্দ্বীপ, হাতিয়া, সুবর্ণচরসহ আশপাশের এলাকার মানুষের জন্যও নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। দ্বীপ ঘিরে নতুন জীবন-জীবিকা শুরু করেছেন অনেকে।
আকারে বড় হচ্ছে ভাসানচর :ধীরে ধীরে আকারেও বড় হচ্ছে ভাসানচর। বিশেষ করে দ্বীপের উত্তর অংশে পলি জমার হার অনেক বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, চরটি ভবিষ্যতে মিলে যেতে পারে সন্দীপের সঙ্গে। আর তা হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ ভাসানচরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বাড়বে।
ভাসানচরে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩’-এর উপ-প্রকল্প পরিচালক নৌবাহিনীর কমান্ডার এম আনোয়ারুল কবির সমকালকে বলেন, বর্ষা মৌসুমে সন্দ্বীপ ও ভাসানচরের দূরত্ব সাড়ে আট কিলোমিটার হলেও শুস্ক মৌসুমে তা দাঁড়ায় তিন থেকে চার কিলোমিটারে। ১০ বছর পর এটি হয়তো সন্দ্বীপের সঙ্গে মিশেও যেতে পারে। এতে ভবিষ্যতে ভাসানচরের যোগাযোগ ব্যবস্থা আমূল পাল্টে যাবে।
প্রকল্প সংশ্নিষ্টরা মনে করেন, সীমিত আয়তনের দেশে বিশাল এই দ্বীপকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। আনোয়ারুল কবির সমকালকে বলেন, ভাসানচরে পর্যটন কেন্দ্র বিকাশের জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি পরিকল্পনা পাঠিয়েছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি প্রতিনিধি দল পর্যটনের সম্ভাবনা মূল্যায়নের জন্য দ্বীপটি পরিদর্শন করেছে। এখানে পর্যটনের বিকাশে ট্যুরিজম বোর্ডসহ সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তারা একত্রে কাজ করতে চান।
ভাসাচরের পর্যটন সম্ভাবনা তুলে ধরে আনোয়ারুল কবির বলেন, সেন্টমার্টিনের চেয়ে ভাসানচরের জমি অনেক ভালো। পর্যটন কেন্দ্রের জন্য সহায়ক যা যা লাগে সেই অবকাঠামো কিন্তু হয়ে গেছে। এখন দরকার একটা ব্যবস্থাপনা। ট্যুরিজম বোর্ডের একটি কমিটি খুব শিগগির এখানে আসবে। তারা এসে দেখবেন, এখানে কোন ধরনের ট্যুরিজম করা যায়। আশা করি, তারা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি বলেন, ভাসানচরে একসময় অনেক বিনিয়োগকারী আসবে। পর্যটন খাত অনেক সমৃদ্ধ হবে। ঘর তৈরি করে থাকার ব্যবস্থা রাখা হবে। গাছপালাও কাটতে হবে না, পরিবেশেরও ক্ষতি হবে না। দ্বীপে দুটি হেলিপ্যাড রয়েছে। ভাসানচরে নির্মিত ওয়াচ টাওয়ার থেকে দ্বীপ এবং সমুদ্রকে পাখির চোখে দেখা যায়।
এদিকে ভাসানচরের সঙ্গে সুবর্ণচর, হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামের নৌযোগাযোগ স্থাপনের জন্য বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গেও নৌবাহিনীর কথা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নোয়াখালীর চেয়ারম্যানঘাটের সঙ্গে ভাসানচরের প্রথম নৌরুট চালু করেছে বিআইডব্লিউটিসি। গত শনিবার সকালে এসটি খিজির-৫ নামের যাত্রীবাহী সি-ট্রাক ভাসানচরে গেছে। চেয়ারম্যানঘাট থেকে ভাসানচরে যেতে প্রতি যাত্রীকে গুনতে হবে ৩৭০ টাকা। হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানান, প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সপ্তাহে দু’দিন এই রুটে সি-ট্রাক চলাচল করবে।
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ভাসানচরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পৌঁছানো, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যাতায়াতের জন্য সি-ট্রাকটি চালু করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ সমকালকে বলেন, ভাসানচর পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা। এটি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে তাদের কাছে ভাসানচরের বিষয়ে এখনও কোনো প্রস্তাবনা আসেনি। প্রস্তাবনা এলে তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।