ডেস্ক নিউজ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রহিমা খাতুন এখন নোয়াখালীর হাতিয়ার চরঈশ্বর ইউনিয়নের ভাসানচরের বাসিন্দা। চার বছর আগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যখন রাখাইন থেকে পালিয়ে আসেন তখন তার চোখে-মুখে ছিল ভয়ডর আর বিষণœতার ছাপ। এখন তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে ভাসানচরে সুখেই কাটছে তার। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান- সবই পেয়েছেন তিনি। নিজেও সেলাইয়ের কাজ করেন। এখন আর গুলি বা আগুনে বাড়িঘর পোড়ানোর দৃশ্য তাকে দেখতে হয় না। তবে এত সুখেও রহিমা খাতুন একটি নির্মম দৃশ্য ভুলতে পারছেন না। রাখাইনে তার স্বামীকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। সেই স্মৃতি তাকে সব সময় তাড়া করে বেড়ায়। বাবা-মা ও ভাইদের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে ভাসানচরে নতুন জীবন শুরু করেন। স্বামীর কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে বলেন, ‘আমার স্বামীকে চোখের সামনে বার্মিজ সেনারা গুলি করে মেরেছে। তার লাশ রেখেই বাচ্চাদের নিয়ে পালিয়ে আসি বাংলাদেশে।’
রাখাইন রাজ্য থেকে আসা মরিয়ম আক্তার নামে আরেকজন নারী বলছিলেন, ‘আমার স্বামী আর তিন ছেলেকে আমার সামনেই হত্যা করা হয়েছে। দুইটা ছেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে গুলি করা হয়। সেখানেই মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ে তারা। ভাসানচরে এসে সব ভুলে দুই ছেলেকে নিয়ে এখন জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছেন মরিয়ম। তিনি জানালেন, গুলি, আগুন বা মৃত্যুর ভয় নেই। বাড়ি পেয়েছি। খাবার পাচ্ছি। চিকিৎসাসেবাও পাচ্ছি। ভাসানচরে স্বাধীনভাবে বেঁচে আছি।’ শুধু রহিমা খাতুন বা মরিয়ম আক্তারই নন, তাদের মতো হাজার হাজার নারী ও পুরুষ ভাসানচরের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাকা বাড়িতে এখন বসবাস করছেন। তারা মিয়ানমারে অনেক আপনজনকে হারিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ ছোটখাটো চাষাবাদ শুরু করেছেন। গবাদিপশু পালনও করছেন অনেকেই। নারীরা হাতের কাজ ও সেলাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। জীবন মান উন্নয়নের জন্য বিআরডিবি নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ভাসানচরে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে ভাসানচরে ৪ হাজার ৫৭২টি পরিবার এসেছে। ভাসানচরে এখন রোহিঙ্গা জনসংখ্যা ১৮ হাজার ৫৩৮ জন। এরমধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী। তাদের থাকা-খাওয়াসহ সব দায়িত্বই সরকার পালন করছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের এখন স্বর্ণযুগ। বাংলাদেশ নৌবাহিনী, পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা চাদরে পুরো ভাসানচর।
জানা যায়, ১ লাখ রোহিঙ্গার বাসস্থানের জন্য ভাসানচরে আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পটি নেওয়া হয়। বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ২ হাজার ৩১২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ধরা হয়। এরই মধ্যে ১ লাখ বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। দ্বীপটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ সরকারের সব প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভাসানচর নামে একটি থানাও গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া ব্র্যাক, কাতার চ্যারিটি, আরটিএন, ইসলামিক রিলিফসহ ২৬টি এনজিও এবং দাতা সংস্থা কাজ করছে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ফ্রেন্ডশিপ, আরটিএনআই, আল্লামা ফজলুল হকসহ বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। ভাসানচরে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা জানান, এ প্রকল্পের আওতায় ভূমি উন্নয়ন ও শোর প্রোটেকশন ওয়ার্ক, বাঁধ নির্মাণ, ১ লাখ ৩ হাজার ২০০ জনের বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি ব্যারাক হাউস ও ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ, দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনীর অফিস ভবন ও বাসভবন, অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো, নলকূপ ও পানি সরবরাহ অবকাঠামো নির্মাণ, পেরিমিটার ফেন্সিং ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, বিভিন্ন যানবাহন ক্রয়, গুদামঘর, জ্বালানি ট্যাঙ্ক, একাধিক হেলিপ্যাড, চ্যানেল মার্কিং ও মুরিং বয়, বোট ল্যান্ডিং সাইট, মোবাইল টাওয়ার, রাডার স্টেশন, সিসি টিভি, সোলার প্যানেল, জেনারেটর ও বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে। গত বুধবার ভাসানচরের গুচ্ছগ্রামগুলো সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, খাওয়া-দাওয়ার টেনশন না থাকায় অধিকাংশ রোহিঙ্গার অলস সময় কাটছে। প্রচন্ড রোদ থাকায় গুচ্ছগ্রামের সারি সারি পাকা বাড়ির বারান্দায় বসে আছেন অনেক নারী-পুরুষ। কেউ কেউ গাছের নিচে বসে আছেন। আবার প্রচন্ড রোদের মধ্যেই দোলনায় দুলছে শিশুরা। কাঁচা বাজারেও দেখা যায় রোহিঙ্গাদের অনেককেই। ভাসানচর হেরা সুপারশপেও কেনাকাটা করতে দেখা যায় অনেক রোহিঙ্গাকে। এ ছাড়াও রিলিফের খাবারের জন্য একটি বিশাল শেডের নিচে অবস্থান করতে দেখা যায় সহস্রাধিক নারী-পুরুষকে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৩ হাজার ৬০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মাঝে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে কাতার চ্যারিটি। খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে দেওয়া হয় চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনি, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, মসলা, চিঁড়া, ড্রাই ফিশ ও আলু। ভাসানচরে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে এই খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছিলেন কাতার চ্যারিটির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ওসমান বশিরসহ অন্যান্য প্রতিনিধি। কাতার চ্যারিটির কর্মকর্তারা জানালেন, ভাসানচরে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গাদের ছয় মাসের খাবার দেওয়া হচ্ছে কাতার চ্যারিটির পক্ষ থেকে।
এ সময় ওসমান বশির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে মানবিক সহায়তা নিয়ে রয়েছে কাতার চ্যারিটি। রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই খাদ্য বিতরণসহ সেবামূলক নানা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কাতার চ্যারিটির এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। কাতার চ্যারিটি থেকে নিয়মিত খাদ্য সহায়তা পেয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ছালেহা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, আমাকে যে খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে, তাতে আমার পাঁচ সদস্যের পরিবারের এক মাস ভালোভাবে কেটে যাবে। প্রতি মাসেই আমি এই খাদ্য সহায়তা পাই। কাতার চ্যারিটিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
এদিকে ভাসানচরে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ ও শিশুদের লম্বা লাইন। রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এসব হাসপাতালে। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সার্জিক্যাল বা ডেলিভারি সমস্যায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় নোয়াখালী সদর হাসপাতালে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, একজন এমবিবিএস চিকিৎসক, দুজন হেলথ অ্যাসিসটেন্ট ও একজন ফিজিও থেরাপিস্ট কাজ করছেন। রেহেনা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী এক শিশুকে নিয়ে আসেন। তিনি জানালেন, তার বাচ্চার চর্মরোগ হয়েছে। তাছাড়া বাচ্চার ওজন ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ফিজিও থেরাপিস্ট মো. মিজানুর রহমান বাচ্চার ওজন মেপে কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ দেন। ভাসানচর সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় দুজন এমবিবিএস চিকিৎসক ডা. ফেরদৌসুর রহমান ও ডা. কামরুল হাসান রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। তারা দুজনই জানান, বড় ধরনের কোনো জটিল রোগ না হলে তারাই সব ধরনের রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা খরচ ও ওষুধপত্র দেওয়া হচ্ছে। জটিল কোনো রোগীকে নোয়াখালী বা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে জানান তারা। চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রোহিঙ্গা নারীরা মুখের নেকাব খুলতে চান না। এ জন্য অনেক সময় জটিলতায় পড়তে হয়। তাছাড়া তারা ফ্যামিলি প্লানিংয়েও বিশ্বাসী না। তারা এটিকে গুনাহের কাজ মনে করে। তবে রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা বলে কিছু কমন সমস্যার কথাও জানা যায়। তাদের অভিযোগ, গোসলের শাবান তারা পান না। প্রচুর মশা মাছি থাকায় মশারি প্রয়োজন। সেটাও সবার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ভাসানচরে প্রচন্ড গরম। এ জন্য ফ্যানের ব্যবস্থা করা জরুরি। কোনো বাড়িতেই ফ্যান দেওয়া হয়নি। মসজিদে মাইক না থাকায় ইফতারি করতেও সমস্যা হয়। অনেকেই আজান শুনতে পান না। অনেকেরই অভিযোগ, কাজ না থাকায় বড় অংশই অলস সময় কাটান। এরমধ্যে কেউ কেউ নানা অপরাধেও জড়িয়ে যান। সম্প্রতি গণস্বাস্থ্যসহ একাধিক হাসপাতাল থেকে তিন বস্তা ওষুধ চুরি করে নিয়ে যায় রোহিঙ্গারা। পরে তাদের শনাক্ত করে থানায় দেওয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো আইন না থাকায় শেষ পর্যন্ত তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের নিয়ে নোয়াখালী আদালতেও যাওয়া হয়। কিন্তু কোন আইনে রোহিঙ্গাদের বিচার করা হবে তা না থাকায় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন বিচারকরা। তবে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের বড় কোনো সমস্যা নেই। থাকা-খাওয়াসহ সব মৌলিক অধিকার পূরণ করা হচ্ছে। ছোটখাটো কিছু সমস্যা আছে। এগুলোও পর্যায়ক্রমে সমাধান করা হবে। একাধিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তারা যে এত কষ্ট স্বীকার করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দিনরাত কাজ করছেন, এর জন্য নেই কোনো ঝুঁকি ভাতা। অতিরিক্ত কোনো বরাদ্দ তারা পান না। এ জন্য অনেকেই এসে দ্রুত চলে যান। এ ব্যাপারে সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া উচিত। চট্টগ্রাম থেকে প্রতি সপ্তাহে একবার মাত্র সি ট্র্যাক আসে। এটা সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন যাতায়াত করা উচিত বলেও মনে করেন তারা। ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জ রঞ্জন চন্দ্র দে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রোহিঙ্গাদের এখানে বড় ধরনের কোনো সমস্যা নেই। তাদের থাকা-খাওয়া সব ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। বড় ধরনের কোনো ক্রাইমও এখানে নেই। ছোটখাটো কোনো সমস্যা হলে আমরা প্রশাসনিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ে সমাধান করি। রোহিঙ্গাদের সব সমস্যা সমাধানেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।