ডেস্ক নিউজ
সরকারের প্রাথমিক টার্গেটই ছিল উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গার মধ্য থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে ১ লাখ সদস্য ভাসানচরে স্থানান্তর করা। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৬ দফায় ১৮ হাজার ৮৪৬ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করাও হয়। এরপর বিশ্বজুড়ে কোভিড পরিস্থিতি এবং ভাসানচর নিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নেতিবাচক মনোভাবের কারণে স্থানান্তর প্রক্রিয়া থমকে যায়। এই প্রক্রিয়া নিয়ে অপপ্রচারও কম চলেনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের কূটনৈতিক প্রয়াসে অবশেষে এলো সফলতা। সরকার পক্ষে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এই প্রক্রিয়া বাস্তব এবং কোন ধরনের দুর্যোগ কবলিত হওয়ার আশঙ্কা না থাকার বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার হওয়ায় আশ্রিতদের উখিয়া-টেকনাফ থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরে অবশেষে যুক্ত হলো বিশে^র অভিভাবক সংস্থা জাতিসংঘ। আগামী ৩ মাসের মধ্যে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা যাবে ভাসানচরে জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে। জাতিসংঘের পক্ষে ইউএনএইচসিআর উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিতদের পাশাপাশি ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদেরও যাবতীয় দেখভাল করবে। তবে সরকারের মূল টার্গেট রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন করানো।
শনিবার এ সংক্রান্ত ঢাকায় একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। সে অনুযায়ী আগামী তিন মাসের মধ্যে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ আশ্রয় শিবির থেকে ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হবে। এ সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর বিশে^র কাছে প্রমাণিত হয়েছে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরটি বাংলাদেশ সরকার মনুষ্য বসবাসের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলেছে। এর আগে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল। শনিবারের সম্পাদিত চুক্তির প্রেক্ষিতে এ সবের অবসান ঘটে।
শনিবার সচিবালয়ে এ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসি-আর)। সমঝোতা স্মারকটিতে সই করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মোহসীন এবং বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিনিধি ইয়োহানেস ফন ডার ক্লাউ। অনুষ্ঠানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ এনামুর রহমান এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
সরকারী সূত্র অনুযায়ী, ভাসানচরে এ পর্যন্ত ৬ দফায় ১৮ হাজার ৮৪৬ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য স্থানান্তরিত হয়েছে। সরকার ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থার সহযোগিতায়। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী আগামী তিন মাসের মধ্যে আরও ৮০ হাজার রোহিঙ্গা স্থানান্তরিত হবে। সরকার এবং ইউএনএইচসিআর যৌথ উদ্যোগে এখন থেকে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা মিয়ানমার কারিক্যুলাম ও ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকায়নের ব্যবস্থা করা হবে। সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কর্মরত জাতিসংঘ এবং এর সহযোগী সংস্থাসমূহ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের বসবাসের কারণে পাশর্^বর্তী এলাকা ও জনগণের ওপর যদি কোন ধরনের বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে তা নিরসনে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের সংখ্যা বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১২ লাখের বেশি। বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় এদের বড় একটি সংখ্যা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফে প্রবেশ করেছে। সর্বশেষ বড় দলটি এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গভীর রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বর্বরোচিত সেনা অভিযানে টিকতে না পেরে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা ৭ লাখের বেশি। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে যে তালিকা করা হয়েছে সে সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। ইতোমধ্যে এসব রোহিঙ্গা পরিবারে এসেছে ১ লাখের বেশি নতুন শিশু। এদের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪ শিবিরে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। নিয়মিত যোগান দেয়া হচ্ছে খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব ধরনের মানবিক সহায়তা। মানবিক কারণে এসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার সময় গড়িয়ে গেছে ৪ বছরের বেশি। ইত্যবসরে মিয়ানমার সরকার দফায় দফায় প্রত্যাবাসনের ইঙ্গিত দিয়ে এবং এমনকি চুক্তি করেও তা থেকে বিরত রয়েছে।
এমনিতর পরিস্থিতিতে কক্সবাজার অঞ্চলে জনসংখ্যা অতি ঘনবসতি ও পরিবেশের মারাত্মক ঝুঁকি হ্রাসে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল এ্যান্ড প্রোটেকশন সাবকমিটির সুপারিশ মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরে ১ হাজার ৪৪০ আশ্রয়গৃহ ও ১২০ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় নৌবাহিনীর সক্রিয় তত্ত¡াবধানে। গেল বছরের ৩ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৪ হাজার ৭২৪ পরিবারের ১৮ হাজার ৮৪৬ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এপ্রিলের পর থেকে কোভিডজনিত কারণে আর কোন রোহিঙ্গা স্থানান্তরিত হয়নি। এরই মাঝে জাতিসংঘসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে স্থানান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করা হয়।
এ অবস্থায় সরকার বিদেশী রাষ্ট্রদূত, বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি এমনকি জাতিসংঘের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্যদের ভাসানচর পরিদর্শন করানো হয়। ভাসানচর পরিদর্শন শেষে এদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। কেননা, ভাসানচরে সরকারী ২৩১২ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে ১২০টি ক্লাস্টার বা গুচ্ছগ্রামের সমন্বয়ে নির্মিত হয়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাসের জায়গা। প্রত্যেকটি ক্লাস্টারে রয়েছে ১২টি করে হাউস। পাকা দেয়ালের ওপর টিনশেডের প্রতি হাউসে রয়েছে ১৬টি কক্ষ। ৪ জন করে একটি পরিবারের সদস্যদের প্রতি কক্ষে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া পুরা ভাসানচরটি ১৩ হাজার একর আয়তনের। এই চরে ১৭০২ একর জমির চতুর্দিকে ১০০ বছরের ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ¡াসের পরিসংখ্যান নিয়ে তৈরি করা হয়েছে উঁচু বাঁধ। এছাড়া রোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য ৪৩২ একর জমি ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রকল্প সম্প্রসারণে এবং বনায়ন কাজে রাখা হয়েছে ৯১৮ একর জমি। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা নৌবাহিনী সূত্রে জানানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের থাকার প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য ৪ তলাবিশিষ্ট একটি আশ্রয় কেন্দ্র। যা ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগে ঘূর্ণিঝড়েও টিকে থাকতে সক্ষম।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর থেকে উখিয়া-টেকনাফ ট্রানজিট ক্যাম্প হয়ে চট্টগ্রামে ৬ ধাপে এনে এদেরকে নৌবাহিনীর জাহাজযোগে ভাসানচরে পৌঁছানো হয়। সেখানে রোহিঙ্গারা ভাল অবস্থানে রয়েছে। যা উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয় শিবির থেকে বহুগুণে উন্নত।
সমঝোতা স্মারক চুক্তি শেষে প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভাসানচর কিংবা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের থাকার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে সেটা সাময়িক। সরকারের মূল লক্ষ্য মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত এসব রোহিঙ্গার দ্রুত প্রত্যাবাসন। সঙ্গত কারণে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসহ অন্যান্য দেশের সার্বিক সহায়তায় প্রত্যাবাসন কাজটি দ্রæত শুরু করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সদ্যসমাপ্ত ৭৬তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে দ্রæত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিশ^ নেতাদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে প্রত্যাবাসন কার্যক্রমে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, কক্সবাজারের মতো ভাসানচরেও জাতিসংঘের অংশগ্রহণ বিষয়ে ত্রাণ সচিবকে সভাপতি করে গত ৩ জুন একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। এ কমিটি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার পর জাতিসংঘ ভাসানচরে মানবিক সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। দু’পক্ষের সঙ্গে আলোচনার পর এমওইউর খসড়া করা হয়েছে সরকার তা অনুমোদন দিয়েছে। এর ফলে অতি শীঘ্রই এ সমঝোতা স্মারকের আলোকে অপারেশন প্ল্যানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু হবে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুর একমাত্র সমাধান তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন। মানবিক সহায়তায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম জানান, এ সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে ভাসানচরে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের মানবিক সহায়তা পরিচালনা সহজতর হবে।
সমঝোতা স্মারক চুক্তি অনুষ্ঠান শেষে ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিনিধি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের সার্বিক সহযোগিতায় মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা দেয়া সহজ হয়েছে। এ জন্য তিনি বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। পরে সংস্থার পক্ষে প্রেরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এ সমঝোতা স্মারকের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের ও জনগণের উদারতা ও সহায়তা আবারও প্রতিফলিত হবে। পাশাপাশি এদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী মানবিক সহায়তায় বাংলাদেশের নেতৃত্বের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা চালু রাখার প্রত্যয়ও আরেকবার ফুটে উঠেছে।
অনুষ্ঠান শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মোহসীন জানান, জাতিসংঘ সংস্থাসমূহ কক্সবাজারের ন্যায় ভাসানচরে মানবিক সহায়তা পরিচালনা করেন। বেসামরিক প্রশাসনের তত্ত¡াবধানে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অতিরিক্ত কিছু আনসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভাসানচরকে ইতোমধ্যে একটি থানায় পরিণত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ ইতোমধ্যে বিশে^র বৃহত্তম আশ্রয় শিবিরে পরিণত হয়েছে।