ভাস্কর্য ইস্যুতে দেশে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতি না হলে এই পোস্টের আবশ্যকতা ছিল না। প্রয়োজন তথা শিক্ষা ও অনুধাবনের তাগিদে দেওয়া হলো।
সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তান একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র। দেশটির সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অন্য অনেক দেশের মুসলমানদের মতো ধর্মাচার পালন করেও আধুনিক মনস্ক। তবে ধর্মান্ধদের দ্বারা প্রায়শ সংঘটিত বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় ও কট্টর বিধিবিধানের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশটি খুবই সমালোচিত।
ইসলামের মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জন্মস্থান বর্তমান সৌদি আরব রাষ্ট্রের কোনো লিখিত সংবিধান নাই। সবেমাত্র ১৯৯২ সালে একটি রাজকীয় ফরমানবলে ৮৩ অনুচ্ছেদের একটি ‘মৌলিক শাসন পদ্ধতি’ (আল নিজাম আল আসাসি লিল হুকম) জারি করা হয় যাকে ‘সংবিধান’ বলা হয় না। এই শাসকরা ব্যাখ্যা করেছেন যে, কুরআন ও সুন্না ব্যতীত কোনো সংবিধান হতে পারে না। মৌলিক শাসনবিধির প্রথম অনুচ্ছেদের সরল অনুবাদ হলো: আল্লার কিতাব কুরআন ও তাঁর রাসুল সাঃ-এর সুন্না এই রাষ্ট্রের সংবিধান।
পাকিস্তানে রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা কায়েদে আযম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ও পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা কবি আল্লামা ইকবালের পূর্ণাবয়ব ভাস্কর্য প্রকাশ্য স্থানে আছে। এগলো সাম্প্রতিক সময়েই স্থাপন করা হয়েছে। আরও কয়েকজন ঐতিহাসিক সম্মানিত ব্যক্তির ভাস্কর্য আছে। কিছু সমালোচনা হলেও দেশের ধর্মীয় নেতারা বা আলেম সমাজ এর বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন করেন না। স্বল্পসংখ্যক উগ্রপন্থী মাঝেমধ্যে আওয়াজ তোলে।
সৌদি আরবে কার্যত ভাস্কর্যের চর্চা নেই। বিভিন্ন অপ্রাণ বস্ত ও মানুষের হাত, উট ও মাছের অস্পষ্ট অবয়বের ত্রিমাত্রিক শৈল্পিক প্রতিকৃতি বা মূর্তি স্থাপন করে নগরসজ্জা আছে। গত বছরের একটি ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচিত হয়। নগরে নগরে বার্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসব চলাকালে জেদ্দায় ৪ঠা জুলাই ২০১৯ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে নিউইয়র্কের বিশ্ববিখ্যাত স্ট্যাচু অফ লিবার্টির একটি বিরাট প্রতিমৃর্তি স্থাপন করে কয়েকদিন রাখা হয়। এটি শুধু মূর্তি নয়, নারীমূর্তি তথা রোমান স্বাধীনতা দেবীর আদলের। সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু সমালোচনা দেখা গেছে। এর বেশি কিছু নয়। দেশটির সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ (মজলিশে হায়াত কিবার আল-উলামা) বা গ্র্যান্ড মুফতি ও ফতোয়া দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ অথবা মক্কা-মদিনার দুটি বড় মসজিদসহ কোনো মসজিদের ইমাম ও আলেমদের কোনো বক্তব্য শোনা যায়নি।
আমাদের দেশে হঠাৎ করে কথিত একদল আলেম যে ভাস্কর্য প্রশ্নে উত্তেজনা সৃষ্টি করলেন তা কি ধর্মবোধ থেকে, না অন্য কোনো উদ্দেশ্যে? ধর্মবোধ থেকে হলে হেদায়াতের রীতিতে শান্তিপূর্ণভাবে মানুষকে বোঝাতেন ও সরকারের প্রতি অাহ্বান জানাতেন। ইসলাম অনুসারে হেদায়াহ বা আল্লাহর নির্দেশিত সঠিক পথ কে পাবে না-পাবে তার মালিক আল্লাহ। রাসুল (সাঃ) ও তাঁর উম্মতের দায়িত্ব শুধু সঠিক পথের আহ্বান জানানো। হুমকি-ধমকি ও ফিৎনা-ফাসাদ বা হাঙ্গামা বাধানোর প্রশ্নই উঠে না। বরং হেদায়াতে জবরদস্তি সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রাচীন কাল থেকে শিল্পকলা হিসেবে ভাস্কর্যের চর্চা হয়েছে। নানা স্থানে অনেক ভাস্কর্য আছে। এতকাল তথা শতাব্দীর প্রথম দশকের আগে পর্যন্ত ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ছিল না। কিছু ইসলামী গ্রুপ প্রথম ২০০৮ সালে বিমানবন্দরের সামনের রাস্তায় লালন ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার দাবি তুলে তাতে সফল হয়।
২০১০ সালে জন্ম নেয় কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ নামক সংগঠন। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার সমর্থনে শাহবাগে ছাত্র-তরুণদের জোরালো সমাবেশের বিরুদ্ধে ‘নাস্তিক’ ধুয়া তুলে ও শাপলা চত্বরে লাগাতার অবস্থান করে ধর্মান্ধতার ১৩-দফা দাবির মধ্যে ভাস্কর্য ইস্যুও সামনে আনে। এদের দাবিতে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি সরানো হয়।
লক্ষ্য করার বিষয় যে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরাক, ইরান, মিশর, তুরস্ক সব মুসলিমপ্রধান দেশে ভাস্কর্য রয়েছে এবং চার মযহাবের অনুসারীসহ সব ধারার মুসলমানরা শিল্প হিসেবে একে মেনে নিলেও বর্তমান সময়ে উন্মত্ত হয়ে ভাস্কর্য ভেঙেছে কেবল ইরাক-সিরিয়ার ইসলামিক স্টেট (প্রথমে আইএসআইএল, পরে আইএসআইএস) ও আফগানিস্তানে তালেবান নামক দুটি কট্টর গোষ্ঠী।
নাইজেরিয়াসহ পশ্চিম আফ্রিকার একাধিক দেশে সক্রিয় বোকো হারাম এই গোত্রেরই। এরা ইসলামের নাম ব্যবহার করলেও নির্ভেজাল রাজনৈতিক সন্ত্রাসী ও সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা মুসলমানদের রক্তেই তাদের হাত বেশি রঞ্জিত করেছে। এদের কার্যকলাপ বিশ্বে ইসলামকে ‘হিংসার ধর্ম’ হিসেবে পরিচিত করায়। এদের তৎপরতার সমসাময়িক কালেই হেফাজতের উদ্ভব। তালেবানের জন্ম ১৯৯৪ ও আইএসের জন্ম ১৯৯৯ সালে। তালেবান শুরু থেকে পাশতুন এলাকার মাদ্রসার শিক্ষক-ছাত্রদের সংগঠন। কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজত ‘অরাজনৈতিক সংগঠন’ পরিচয়ে কাজ করে, কওমী মাদ্রাসার ডিগ্রির স্বীকৃতির জন্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছে। এরা সন্ত্রাসবাদী নয়, সশস্ত্র নয়, প্রকাশ্য শান্তিপূর্ণ সভাসমাবেশ ঘটিয়ে কাজ করে। কিন্তু হেফাজতসহ আলেম সমাজের একটি অংশ ঠিক আইএস-তালেবানের মতো ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু হিংস্র আওয়াজ কেন তুলছে, যেখানে সারা বিশ্বে মুসলিম শাসক, উলেমা ও মুসলিম জনগণ শিল্প হিসেবে ভাস্কর্য গ্রহণ করেছে?
উগ্রপন্থী রাজনৈতিক আলেমদের এই কার্যকলাপ সম্পর্কে দেশের সকল ইসলামী আলেম, মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন ও ধার্মিক মুসলিম জনসাধারণের সবুরের সঙ্গে ভেবে দেখে দেশ, ধর্ম ও জাতির স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
কয়েক বছর তুলনামূলক নীরব থেকে এই নভেম্বর মাসে হঠাৎ কয়েকজন আলেম-রাজনীতিক বিশেষভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য টার্গেট করে হুঙ্কার ছাড়লেন ও কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য রাতের অন্ধকারে ভাঙা হলো, কেন? কী উদ্দেশ্যে?