- টিকা দেয়া শুরু হলেই মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে
- গতি পাবে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড
- ভ্যাকসিন ক্রয়, সংরক্ষণ ও সরবরাহের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার
গত বছরের পুরোটাই ছিল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিধ্বংসী এক বছর। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও বিপর্যস্ত করেছে এই ভাইরাস। বাংলাদেশ খানিকটা চাপ অনুভব করলেও গত বছর বৈশ্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মারাত্মকভাবে। তবে ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতি কোন্ দিকে যাবে তা নিয়ে চলছে গবেষণা। বিশ্বব্যাংকের মতে, করোনা সঙ্কট-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় চালকের আসনে থাকবে ‘ভ্যাকসিন’ আর বিভিন্ন ধরনের ‘বিনিয়োগ’। প্রাণঘাতী এই ভয়াবহ ভাইরাস মোকাবেলা করতে বিশ্বব্যাপী ২০০টি সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের মধ্যে ৫০টির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি কোম্পানি তাদের ভ্যাকসিন চূড়ান্ত করে বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ শুরু করেছে। সম্প্রতি করোনা ভ্যাকসিন ক্রয়, সংরক্ষণ ও সরবরাহের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ভারতে অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ৩ কোটি ডোজ টিকা আনছে বেক্সিমকো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের মহামারী চলাকালীন ভ্যাকসিন ছাড়া অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। তারা বলছেন, ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হলেই মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে কর্মকান্ড গতি পাবে। এটা অনেক দেশই শুরু করেছে, বাংলাদেশেরও শুরু করা প্রয়োজন।
জানা যায়, এক ধরনের অনিশ্চয়তা নিয়েই শুরু হয়েছিল ২০২০। চীনে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার পর তাদের বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। বাংলাদেশের রফতানির ৬০ শতাংশেরও বেশি অংশের গন্তব্য ইউরোপে দ্রুত হারে বাড়তে শুরু করে করোনার সংক্রমণ। যদিও তখনও ভাইরাসটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি, কিন্তু এর সংক্রমণের ফলে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক সঙ্কটের আঁচ তখন বাংলাদেশও অনুভব করতে শুরু করে। দুঃসংবাদটি আসে কয়েক মাস পর। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। এর সপ্তাহখানেক পর করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর কিছুদিনের মধ্যেই করোনার সংক্রমণ মোকাবেলায় দেশব্যাপী ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ফলে অর্থনীতিতে এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি সাময়িকভাবে স্থবির হয়ে পড়ে। মার্চের দ্বিতীয়ার্ধে ১০ দিনেরও কম সময়ে পুঁজিবাজারের মূল্যসূচক ১৫ শতাংশ কমে যায়। দেশব্যাপী সাধারণ ছুটিকে কেন্দ্র করে চাকরি হারিয়েছে বহু মানুষ, অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের সিংহভাগ মানুষের আয় কমে যায়। আমদানিকারক দেশগুলো তাদের অর্থনীতি সচল রাখতে হিমশিম খাওয়ায় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের রফতানি খাত। এপ্রিলে জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার ঘোষণা করেছে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশে ঘোষিত সবচেয়ে বৃহৎ অঙ্কের প্রণোদনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এরপর গত জুনে দেশের অর্থনীতি পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত সাহসী একটি পদক্ষেপ ছিল এবং যেহেতু এরপর ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি, তাই এটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হিসেবেও প্রমাণিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বছরে করোনা মহামারী থেকে মুক্তি পেতে একমাত্র আশার আলো ভ্যাকসিন বা টিকা। নতুন বছরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা ও বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রণোদনা প্যাকেজ শতভাগ বাস্তবায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে সরকারকে। জানতে চাইলে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন বছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা ও বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এর উপরেই আগামীর অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অনেক কিছু নির্ভর করবে। সুতরাং এদিকে খুব ভালভাবে নজর দিতে হবে। এতে অনেক অনিশ্চয়তা দূর হবে। তা না করতে পারলে ২০২০ সালে আমরা যে অনিশ্চয়তা দেখেছি তা আরও ঘনীভূত হবে। তিনি বলেন, ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি বিভিন্ন দিক দিয়েই ধাক্কা খেয়েছে। কর্মসংস্থান, মানুয়ের আয়, অর্থনৈতিক অবস্থা- সবদিক থেকেই। অর্থাৎ অর্থনীতিক বিপর্যয়, মানবিক বিপর্যয়, স্বাস্থ্য বিপর্যয়- এর মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি। তবু ভাল যে, বিশ্বে চতুর্থ বিপর্যয় যোগ হয়েছিল, খাদ্য বিপর্যয়। যা আমাদের দেশে হতে পারেনি। এটি আমাদের দেশের একটি শক্তিমত্তার জায়গা ছিল।
গত আগস্টে ভারত থেকে টিকা এনে বাংলাদেশে সরবরাহের জন্য সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় দেশের ওষুধ খাতের শীর্ষ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। এরপর গত বছরের নবেম্বরে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা পেতে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে বাংলাদেশ সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড এবং বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে।
সে মোতাবেক সেরাম ইনস্টিটিউটের ব্যাংক হিসাবে ভ্যাকসিনের অর্থ জমা করার আগের দিন ২ জানুয়ারি রফতানি নিষেধাজ্ঞার খবর আসে। এ বিষয়ে সেরাম ইস্টিটিউটের জনসংযোগ কর্মকর্তা মায়াঙ্ক সেন গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন রফতানিতে নিষেধাজ্ঞার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা পুরোপুরি সঠিক নয়। কারণ তাদের ভ্যাকসিন রফতানির ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে করোনা ভ্যাকসিন রফতানির অনুমোদন পেতে আরও কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগবে বলেও জানান মায়াঙ্ক সেন। সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে বাংলাদেশ অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার ৫০ লাখ ডোজ টিকা আগামী মাসের শুরুতে পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ হিসেবে পুরো তিন কোটি টিকার জন্য অগ্রিম হিসেবে এরই মধ্যে ছয়শ’ কোটি টাকা সেরামের এ্যাকাউন্টে রবিবার জমা হয়েছে। জানতে চাইলে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা বলেন, ‘সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আমাদের চুক্তি অনুযায়ী, আগামী এক মাসের মধ্যে আমরা প্রথম লটের টিকা পাব। সেই চুক্তি অনুযায়ী, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’। করোনাভাইরাসের মহামারী চলাকালীন ভ্যাকসিন ছাড়া অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হলেই মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে কর্মকান্ড গতি পাবে। এটা অনেক দেশই শুরু করেছে, বাংলাদেশেরও শুরু করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলো যত তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিন বিভিন্ন দেশ থেকে আনা যায়। সব দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের যোগাযোগ রাখা দরকার। যাতে কোন একক দেশের ওপর নির্ভরশীল না থাকতে হয়। কারণ যত বেশি দেশের সঙ্গে ভ্যাকসিন নিয়ে যোগাযোগ থাকবে তত বেশি ‘বার্গেইনিং পাওয়ার’ থাকবে বাংলাদেশের কাছে। বাংলাদেশ যেহেতু সব দেশের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে, সেক্ষেত্রে সব দেশের কাছ থেকে ভ্যাকসিন নেয়ার আলোচনা চালানো যেতেই পারে। তিনি বলেন, মহামারী মোকাবেলার সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা অর্থনৈতিক কূটনীতি সবকিছুরই সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশ যত তাড়াতাড়ি মহামারী মোকাবেলা শেষ করতে পারবে তত তাড়াতাড়ি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।
এদিকে সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে করোনার ভ্যাকসিন কেনা, সংরক্ষণ ও সরবরাহের জন্য ৪ হাজার ২৩৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠকে জানানো হয়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের প্রথমে টিকা দেয়া হবে। বিশেষ কারণ ছাড়া ১৮ বছরের নিচে কাউকে টিকার আওতায় আনা হবে না। এভাবে পর্যায়ক্রমে দেশের ১৩ কোটি ৭৬ লাখ মানুষকে করোনা টিকার আওতায় আনা হবে।
অন্যদিকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা উৎপাদন করার অনুমোদনও পেয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ডাঃ আসিফ মাহমুদ সাংবাদিকদের।
জানান, তারা এই টিকার নাম দিয়েছেন ‘বঙ্গভ্যাক্স’। যেকোন ওষুধ উৎপাদনের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমতি প্রয়োজন হয়। অধিদফতর গ্লোব বায়োটেককে এই টিকা উৎপাদনে অনুমতি দিয়েছে। টিকা উৎপাদনের পর গ্লোব বায়োটেক টিকার ট্রায়ালের অনুমোদনের জন্য চেষ্টা চালাবে বলে আসিফ মাহমুদ জানান। এর আগে গত বছরের ২ জুলাই নতুন করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) টিকা উদ্ভাবনের দাবি করেছে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রুপ অব কোম্পানিজ লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোন প্রতিষ্ঠান এই টিকা উদ্ভাবনের দাবি করল। প্রতিষ্ঠানটি গত ৮ মার্চ এই টিকা তৈরির কাজ শুরু করে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, নতুন বছরে চালকের আসনে থাকবে ভ্যাকসিন ॥ সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, করোনা সঙ্কট পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় চালকের আসনে থাকবে ভ্যাকসিন আর বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগ। ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসবে উল্লেখ করে সংস্থাটি জানায়, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের হিসেবে এখনও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া এক ধরনের ঝুঁকি রয়ে গেছে, এমনকি দীর্ঘ সময় মানুষের আয়-রোজগারে চলমান সঙ্কট বহাল থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে।
সংস্থাটি জানায়, বিপুল পরিমাণে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগ না করা গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সারা বছর ধরে ভ্যাকসিনেশন চালু রাখার ওপরও জোর দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। দেশগুলো এ কার্যক্রম সফলভাবে করবে ধরে নিয়েই সংস্থাটি মনে করছে ২০২১ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসবে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে ভাইরাসটিকে বশে আনতে হলে ২০২১ সালে বৃহৎ জনগণকে টিকা দেয়াই হবে মূল চাবিকাঠি। বর্তমানে আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর হিসেবে প্রতিশ্রুতি দেয়া ভ্যাকসিন ফাইজার, মডার্না ও অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকা।’ তিনি বলেন, ‘কাঠামোগত সংস্কার পুনরুজ্জীবিত করা, মহামারীজনিত কারণে হুমকির সম্মুখীন দক্ষ ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোর জন্য নীতিগত সহায়তা নিশ্চিত করা এবং কাউকে পেছনে না রেখে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করাই হবে সঙ্কট নিরসনে আমাদের মূল বিষয়।
দাম বেশি মডার্নার, কম দাম এ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের ॥ ইউনিসেফ, মার্কিন সরকারী চুক্তি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি মডার্না ভ্যাকসিন প্রতি ডোজের দাম নিচ্ছে সর্বনিম্ন ২৫ ও সর্বোচ্চ ৩৭ ডলার। এ পর্যন্ত যতগুলো ভ্যাকসিন চূড়ান্ত করা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে দামী এই মাডার্না ভ্যাকসিন। চীনের তৈরি সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন প্রতি ডোজের দাম নিচ্ছে সর্বনিম্ন ১৩ ও সর্বোচ্চ ২৯.৭৫ ডলার। ফরাসী কোম্পানি সানোফি ও ব্রিটেনের গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের যৌথভাবে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন প্রতি ডোজের দাম নিচ্ছে সর্বনিম্ন ১০.৬৫ ও সর্বোচ্চ ২১ ডলার। জার্মানির বায়োএনটেক এবং তাদের অংশীদার বৃহৎ আমেরিকান কোম্পানি ফাইজার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন প্রতি ডোজের দাম নিচ্ছে সর্বনিম্ন ১৮.৩৪ ও সর্বোচ্চ ১৯ ডলার। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনার ভ্যাকসিন প্রতি ডোজের দাম নিচ্ছে সর্বনিম্ন ৪ ও সর্বোচ্চ ৮.১ ডলার। এ পর্যন্ত যতগুলো ভ্যাকসিন এসেছে তার মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্যের ভ্যাকসিন এটি। এছাড়া ব্রিটিশ ওষুধ সংস্থা এ্যাস্ট্রোজেনেকা ও মার্কিন ভ্যাকসিন উৎপাদক নোভাভ্যাক্সের যৌথভাবে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন প্রতি ডোজের ভিত্তি মূল্য ধরা হয়েছে ১৬ ডলার। মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান জনসন এ্যান্ড জনসনের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন প্রতি ডোজের ভিত্তি মূল্য ধরা হয়েছে ১০ ডলার। জার্মান বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কিউরভ্যাক উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন প্রতি ডোজের ভিত্তি মূল্য ধরা হয়েছে ১১.৮৪ ডলার। রাশিয়ার স্পুটনিক ভি করোনা ভ্যাকসিন প্রতি ডোজের ভিত্তি মূল্য ধরা হয়েছে ১০ ডলার।
ধনী দেশগুলো ‘টিকা মজুদ করছে ॥ বিশ্বের ধনী দেশগুলো কোভিড-১৯ টিকার বেশিরভাগ ডোজ মজুদ করছে, যার কারণে দরিদ্র দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষ প্রাণঘাতী নতুন করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার ও দাতা সংস্থার একটি জোট। এখনকার হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৭০টি নিম্ন আয়ের দেশ তাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে মাত্র একজনকে কোভিড-১৯ এর টিকা দিতে পারবে বলে জানিয়েছে পিপলস ভ্যাকসিন এ্যালায়েন্স। বিশ্বজুড়ে ন্যায্য ও সুষ্ঠুভাবে টিকা সরবরাহে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ভ্যাকসিন সরবরাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জোট কোভ্যাক্স ৯২টি নিম্ন আয়ের দেশে ৭০ কোটি ডোজ টিকা পাঠানোর চুক্তিও করেছে। কিন্তু এতসব পরিকল্পনার পরও বিশ্বব্যাপী ন্যায্য টিকা বিতরণ সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফাম, গ্লোবাল জাস্টিস নাও-সহ বিভিন্ন সংস্থার নেটওয়ার্ক পিপলস ভ্যাকসিন এ্যালায়েন্স। যেসব সম্ভাব্য টিকা নিয়ে আলোচনা চলছে, তার সবই যদি ব্যবহারের অনুমতি পায় তাহলে ধনী দেশগুলো যত টিকার ক্রয়াদেশ দিয়েছে তাতে তাদের মোট জনসংখ্যাকে তিনবার টিকা দেয়া যাবে বলে বলছে ভ্যাকসিন এ্যালায়েন্সের হিসাব।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটি, ইউনিসেফ ও বিজ্ঞানবিষয়ক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান এয়ারফিনিটির তথ্য মতে, এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি টিকার অর্ডার পেয়েছে অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকা। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ৩২৯ কোটি ডোজের ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এছাড়া নোভান্যাক্স ১৩৮, ফাইজার-বায়োএনটেক ১২৮, জনসন এ্যান্ড জনসন ১২৭, সানোফি/জিএসকে ১২৩, মডার্না ৭৮, কিউরভ্যাক ৪১, স্পুটনিক-ভি ৩৪ কোটি, সিনোভ্যাক ২৬ ও কোভ্যাক্স ১৪ কোটি ডোজের অর্ডার পেয়েছে।
ভ্যাকসিন তৈরিতে অর্থের উৎস ॥ বৈজ্ঞানিক উপাত্ত বিশ্লেষণকারী কোম্পানি এয়ারফিনিটি বলছে, ভ্যাকসিন তৈরিতে সব মিলিয়ে সরকারগুলো দিয়েছে ৮৮৪ কোটি ডলার। এ ছাড়া অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো দিচ্ছে প্রায় ২০৪ কোটি ডলার। কোম্পানিগুলো নিজেরা বিনিয়োগ করেছে মাত্র ৩৫৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। তবে এর মধ্যে অনেকে আবার বাইরের তহবিলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। মডার্না ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৮০ কোটি ৬৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার। যার পুরোটাই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। তবে মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান জনসন এ্যান্ড জনসনের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের ৫৮ কোটি ৩৪ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পুরো অর্থ এসেছে অলাভজনক খাত থেকে। যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনার ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে খরচ হয়েছে ৫৫ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এই ভ্যাকসিন তৈরিতে অলাভজনক, ব্যক্তিগত ও এসেছে সরকারী তহবিল থেকে অর্থ দেয়া হয়েছে।
ওষুধ সংস্থা এ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মার্কিন ভ্যাকসিন উৎপাদক নোভাভ্যাক্সের যৌথভাবে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনে খরচ হয়েছে ১৫৯ কোটি ১২ লাখ ডলার। যার পুরোটাই এসেছে দুটি রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে। জার্মান বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি কিউরভ্যাক উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনে খরচ হয়েছে ১১৫ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। সরকারী ও ব্যক্তিগত খাত থেকে এই ভ্যাকসিন তৈরিতে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। ফরাসী কোম্পানি সানোফি ও ব্রিটেনের গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের যৌথভাবে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনে ব্যক্তিগত খাত থেকে খরচ হয়েছে ৫৮ কোটি ৩৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার। জার্মানির বায়োএনটেক এবং তাদের অংশীদার বৃহৎ আমেরিকান কোম্পানি ফাইজার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৫৫ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু দেশে বিতর্ক ॥ ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা প্রতিরোধক ভ্যাকসিনের গণপ্রয়োগ শুরু হয়েছে। তবে এর কার্যকারিতা এবং আরও কিছু বিষয় নিয়ে কিছু দেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েলসহ কয়েকটি দেশে ভ্যাকসিন নেয়ার পরও মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও দেশগুলোতে ভীতি কাজ করছে। আবার মুসলিম দেশগুলোতে ‘হালাল-হারাম’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।