ডেস্ক নিউজ
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা কমেছে। বাংলাদেশেও করোনার মৃত্যুর হার নেমে এসেছে শূন্যের কাছাকাছি। শনাক্তের হারও নেমে এসেছে দেড় বছরের সর্বনিম্নে। একই সঙ্গে বিস্তৃত হচ্ছে টিকাদান কর্মসূচি। বিনামূল্যে গণটিকার কার্যক্রম শুরুর দিকে অর্থায়নের চাপে পড়লেও বাংলাদেশ এখন অনেকটাই চাপমুক্ত। গ্লোবাল ভ্যাকসিনেশন অ্যালায়েন্সের (গাভি) দেওয়া ভ্যাকসিনের বদৌলতে বাংলাদেশ প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত কার্যক্রম বিস্তৃত করতে পেরেছে। ভ্যাকসিন কার্যক্রম জোরদার করতে এখন বিশ্বব্যাংক ও এডিবি অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশকে। যার একটা বড় অংশ ইতোমধ্যে ছাড় করেছে সংস্থা দুটি। মানুষের মধ্যে ভ্যাকসিন ও করোনা নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত সচেতনতাও বেড়েছে। বিভিন্ন উৎস থেকে ভ্যাকসিন এনে গণটিকা দেওয়ায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। ফলে দৃশ্যত না হলেও মনোবলের দিক থেকে বিশ্বের উন্নয়নশীল অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন কার্যক্রম বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এশিয়ার দেশ হিসেবে আফগানিস্তান ও মিয়ানমারের চেয়ে সরাসরি এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। জনসংখ্যার ঘনত্বের ভিত্তিতেও অনেক দেশের তুলনায় ভ্যাকসিন কার্যক্রমে ভালো করছে বাংলাদেশ। প্রতিজনে দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিতে হয়। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায়। সংখ্যার দিক থেকে প্রায় ৬ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ভ্যাকসিন কিনে তা অর্থের বিনিময়ে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্যই কঠিন। ফলে বিশ্বের ধনী দেশ ও সংস্থাগুলো দরিদ্র দেশগুলোর পাশে দাঁড়ায় এ ধরনের মহামারীতে। যার সুবিধা এবার বাংলাদেশও পেয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত করোনা ভ্যাকসিন সংক্রান্ত এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে চলমান টিকাদান কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে প্রতি মাসে ২ কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। সে মোতাবেক টিকা কর্মসূচি চলছে। চলতি বছরের শেষ দুই মাসে আরও অন্তত ৪ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োগ করতে চায় সরকার।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা প্রতি মাসে ২ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিক থাকলে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নও হবে। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন কার্যক্রম অনেকটাই জোরদার করা হয়েছে। সব শ্রেণির মানুষকেই ভ্যাকসিনের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার বলে তিনি মনে করেন। বিশ্বব্যাংক ও ডব্লিউআইডির তথ্যমতে, বিশ্বের প্রায় ৪৮ শতাংশ মানুষ অন্তত ১ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে। তবে বিশ্বের নিম্ন আয়ের মানুষের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির হার খুবই নগণ্য। এ শ্রেণির মানুষ মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশ অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে। এটাকে খুবই হতাশাজনক এবং বৈষম্যমূলক নীতি বলে মনে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাক্তার মোজাহেরুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রত্যেক দেশই নিজেদের অবস্থান থেকে চেষ্টা করছে ভ্যাকসিন তৈরি ও ভ্যাকসিন প্রয়োগের। অনেক দেশেই ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও তা শুরু হয়েছে। এটা আশাব্যঞ্জক। এ প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। গত বছরের শেষ ও চলতি বছরের শুরুতে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও চাপ হয়ে দাঁড়ায় ভ্যাকসিন কেনার অর্থ নিয়ে। যদিও তার আগে থেকেই ভ্যাকসিনের অর্থের জোগান পেতে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে সরকার। একদিকে করোনার প্রভাবে সরকারের রাজস্ব আদায় কমতে থাকে। অন্যদিকে প্রথম দফা লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতেও উদ্যোগ নেয় সরকার। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও অর্থায়নের জোগান পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। তবে বর্তমানে সে চাপও অনেকটা কমে এসেছে। করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের হারও নেমে এসেছে দেড় বছরের সর্বনিম্ন। ফলে সর্বস্তরের জনসাধারণ ও সরকারের মধ্যে করোনাভাইরাস ও ভ্যাকসিন পরিস্থিতিতে এক ধরনের স্বস্তি বিরাজ করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছে। এ নিয়ে সংস্থা দুটির সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। আবার ভ্যাকসিন কেনার বিকল্প অর্থায়নের উৎস হিসেবে অভ্যন্তরীণভাবে অর্থ সংস্থানের পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার। এজন্য চলতি অর্থবছরে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেখান থেকেও প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানো হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে এডিবির সদ্য বিদায়ী কান্ট্রি ডিরেক্টর মনমোহন প্রকাশ বলেন, করোনার টিকা সংগ্রহের জন্য এটি এককভাবে এ পর্যন্ত আমাদের দেওয়া সবচেয়ে বড় সহায়তা। সাশ্রয়ী দামে মানসম্পন্ন টিকা দ্রুত কেনার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে এডিবি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মানুষের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা এবং কভিড-১৯ মহামারী থেকে দ্রুত আর্থসামাজিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিতে নিরাপদ ও কার্যকর টিকার ব্যবস্থা করা গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে চলতি বছরের এপ্রিলে ভ্যাকসিনের অর্থায়ন-সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে চুক্তি অনুযায়ী, করোনারভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন কিনতে বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার (স্থানীয় মুদ্রায় ৪ হাজার ২৫০ কোটি টাকা) ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। কভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপার্ডনেস’ প্রকল্পের আওতায় অতিরিক্ত ঋণ সহায়তা হিসেবে এ ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। চলতি সময় থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, সরকারের সবশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে বিনামূল্যে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হবে। ফলে প্রথম দিকে টাকার বিনিময়ে ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে ভ্যাকসিন ক্রয়ের সিংহভাগ অর্থই আয় করা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন আর সেটা হচ্ছে না। যেহেতু সরকার বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেহেতু প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকাই সরকারকে বহন করতে হবে। এর বেশিরভাগ অর্থই আসছে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ থেকে। যার ফলে বাংলাদেশ সরকার ভ্যাকসিনের অর্থায়ন প্রসঙ্গে অনেকটাই চাপমুক্ত বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক।