ডেস্ক নিউজ
একসময় দেশে মাদকের বাজারে গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার আধিপত্য থাকলেও সম্প্রতি বিস্তার ঘটছে আলোচিত ক্ষতিকর মাদক আইস (মেথামফেটামিন) বা ক্রিস্টাল মেথের। আইস দেশে আবির্ভূত হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তখন রাজধানীর জিগাতলার একটি বাসায় ধরা পড়ে মাত্র পাঁচ গ্রাম। এরপর ওই বছরের জুন মাসে রাজধানীর খিলক্ষেতে ধরা পড়ে ৫২২ গ্রাম আইস। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা তৎপরতায় ওই বছর এবং তার পরের বছর ২০২০ সালে আইস আসা কমে যায়। ২০১৯ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মোট ৫৬১ গ্রাম আইস জব্দ করে। পরের বছর ২০২০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও কোস্ট গার্ডসহ সব সংস্থা জব্দ করে দশমিক ০৬৫ গ্রাম আইস।
কিন্তু ২০২১ সালে উদ্বেগজনক আকারে আসে এ মাদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও কোস্ট গার্ডসহ বিভিন্ন সংস্থা গত বছর ৩৬ কেজি ৭৯৪ গ্রাম আইস জব্দ করে। প্রতি গ্রামের দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ধরে জব্দ আইসের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা।
প্রচুর আইস আসার এই ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে চলতি বছরও। এর মধ্যে সম্প্রতি দেশে আইসের সর্ববৃহৎ চালান ধরা পড়ে। গত ২ মার্চ রাতে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় সাড়ে ১২ কেজি আইস জব্দ করা হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকারও বেশি। এ সময় চক্রের মূলহোতা জসিম উদ্দিন ওরফে জসিমসহ (৩২) গ্রেফতার করা হয় পাঁচ মাদক কারবারিকে।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এই চক্র কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে গভীর সমুদ্রে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার আড়ালে আইস ও ইয়াবা সংগ্রহ করে কৌশলে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে আসছিল।
এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি এক কেজি আইস ও ইয়াবাসহ তিন মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করে বিজিবি। গত ১৪ জানুয়ারি ভোরে কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক সংলগ্ন দরগারছড়া এলাকা থেকে আড়াই কেজি আইস জব্দ করে কোস্ট গার্ড।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এভাবেই দেশে মাদক আনছে চোরাকারবারিরা। চক্রগুলো তাদের ক্রেতাদের হাতে মাদক পৌঁছে দিতে নানা কায়দা-কানুন অবলম্বন করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইস লবণের মতো দানাদারজাতীয় মাদক। দেখতে কখনো চিনির মতো কখনো মিসরির মতো। আইস উচ্চমাত্রার মাদক, যা সেবনের পর মানবদেহে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আইসের দাম ইয়াবার চেয়ে অনেক বেশি। আবার ক্ষতি বা প্রভাবও বেশি। এটি অতিরিক্ত সেবনে মস্তিষ্ক বিকৃতিতে মৃত্যুও হতে পারে। তাছাড়া অনিদ্রা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, হৃদরোগকে বেগবান করে এ মাদক। এটি সয়লাব হলে ইয়াবার চেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে তরুণ সমাজ।
jagonews24
র্যাব বলছে, মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যবর্তী সমুদ্র এলাকায় মালবাহী নৌকায় আসছে ইয়াবা ও আইসের চালান। সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মিয়ানমার থেকে আসা নৌকা থেকে মাদক শিফট হয়। সেখানে মাছের নৌকাসহ বিভিন্ন মালামালের নৌকা থাকে। এর মধ্যে কোন নৌকায় ইয়াবা কিংবা আইস আসছে—এটি বুঝতে মাদক কারবারিরা টর্চলাইটের সিগন্যাল ব্যবহার করে। পরে তারা সুবিধাজনক সময়ে নৌকা ভিড়িয়ে খালাস করে ও টেকনাফের বিভিন্ন নিরাপদ বাসায় মজুত করে। এরপর আচারের প্যাকেট, বিভিন্ন চায়ের ফ্লেভারের প্যাকেট ও বার্মিজ কাপড়ের প্যাকেটে ঢাকায় আনে আইস ও ইয়াবা।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় গ্রেফতার মাদক চক্রকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব জানায়, সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে ট্রলারের মাধ্যমে মিয়ানমারের মাদক চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশে এ চক্রের কাছে ইয়াবা ও আইসের চালান হস্তান্তর করে। সাগরপথে মাদকের চালান নেওয়া ও নিরাপদে পৌঁছানোর জন্য এ চক্রের সদস্যরা ২০-২৫ দিন জেলের ছদ্মবেশে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করে। মাদক নেওয়ার পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসে। পরে সেগুলো সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়। এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রটি সোনাদিয়া থেকে দুটি বোটের মাধ্যমে নোয়াখালীর হাতিয়া নিয়ে আসে। হাতিয়ায় থাকা চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে মাদকের চালান সংরক্ষণ করা হয়। এরপর ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মেঘনা নদী হয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি পৌঁছে দেওয়ায় হয় বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জাগো নিউজকে বলেন, বৈধ ব্যবসা ও মাছ ধরার আড়ালে সাগরপথে একটি চক্র মিয়ানমার থেকে আইস ও ইয়াবা বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। সাগরপথে মাদকের চালান নেওয়া ও নিরাপদে পৌঁছানোর জন্য এ চক্রের সদস্যরা জেলের ছদ্মবেশে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করে। মাদক নেওয়ার পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসে। পরে সেগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেওয়া হয়।
চালান ধরা পড়লে এদেশের কারবারি থেকে টাকা নেয় না মিয়ানমারের কারবারিরা
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনতে সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করলেও মাদক কারবারিরা আইস আনছে বাকিতে। মাদকসেবীদের কাছে বিক্রি হওয়ার পরে দেশের কারবারিরা মিয়ানমারের কারবারিদের কাছে ৭-১৫ দিন পর আইসের মূল্য পরিশোধ করে। মিয়ানমার থেকে আইস আনার পর যদি বাংলাদেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জব্দ করে তাহলে মিয়ানমারের কারবারিরা টাকা নেয় না।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ইয়াবার সঙ্গে বাংলাদেশে আইসের বাজার বড় করতে মিয়ানমারের কারবারিরা এ মাদক কম মূল্যে বিক্রি করছে। এক গ্রাম আইসের দাম মিয়ানমারের কারবারিরা রাখছে দুই থেকে তিন হাজার টাকা, যা বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে ১৫-২৫ হাজার টাকায়। বেশি লাভজনক হওয়ায় মাদক কারবারিরা আইসে ঝুঁকছে।
কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশি মাদক কারবারিরা যখন মাদক নিয়ে আসে তখন পার্শ্ববর্তী দেশে তাদের এজেন্ট থাকে। এজেন্টের কাছ থেকে দেশের কারবারিরা রিসিভ করে মাদক নিয়ে আসে। যখন মাদক নিয়ে আসে তখন এজেন্টের কাছে টাকার বদলে বিভিন্ন জিনিস জিম্মায় রাখে। বাংলাদেশি মাদক কারবারিদের ভাই অথবা আপন কেউ পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্টের কাছে জিম্মায় থাকে। এরপর দেশে মাদক বিক্রির পর মাদকের টাকা পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্টের কাছে পৌঁছে দেয়।
jagonews24
মিয়ানমারের সিম ব্যবহার করে মাদক নিয়ে আসার বিষয়ে কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে মিয়ানমারের মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক পায়। এ কারণে পার্শ্ববর্তী দেশের মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য মিয়ানমারের মোবাইল কোম্পানির সিম ব্যবহার করে দেশের কারবারিরা।
স্পিডবোট পাচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর
সমুদ্রপথে মাদক আসা ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্ট গার্ডের পাশাপাশি তৎপর হচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও। মাদকবিরোধী কার্যক্রম জোরদার এবং নৌপথে মাদকপাচার প্রতিরোধে জাপান সরকারের শুভেচ্ছা হিসেবে ইউএনওডিসির (জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত কার্যালয়) সহায়তায় দুটি স্পিডবোট পেয়েছে তারা। আরও কয়েকটি স্পিডবোট তাদের দেওয়ার আলোচনা চলছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) উপ-পরিচালক (উত্তর) রাশেদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে নৌকায় ও মাছের ট্রলারে লুকিয়ে দেশে আসছে ইয়াবা ও আইস। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নৌপথে কার্যক্রম চালু হবে। এরই মধ্যে আমরা বোট পেয়েছি। আগের তুলনায় আমাদের অভিযান বাড়বে। আমরা আমাদের কৌশল পরিবর্তন করছি। আমরা সবসময় অভিযান পরিচালনা করছি এবং আইসসহ বিভিন্ন মাদক জব্দ করছি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এতদিন স্থলপথে অভিযান চালালেও বোট না থাকায় গভীর সমুদ্রে কার্যক্রম সম্ভব ছিল না। আমাদের নিয়মিত টহলে প্রতিনিয়ত মাদক জব্দ করছি আমরা। বোট পাওয়ার কারণে আগের চেয়ে আমাদের অভিযান বেড়ে যাবে এবং নৌপথে মাদকের তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেসব জব্দ করতে পারবো।
মাদক ঠেকাতে সীমান্তে বসবে অত্যাধুনিক সেন্সর
প্রতিবেশী দুই দেশ থেকে মাদক প্রবেশ রোধে সীমান্তে অত্যাধুনিক সেন্সর ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সদর দপ্তরে ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মাদকের ভয়াল থাবা থেকে আমাদের প্রজন্মকে রক্ষার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি। ভয়ংকর মাদক ইয়াবা ও আইস প্রবেশ রোধে সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করছি। সীমান্তে সেন্সর লাগানো হচ্ছে। মাদককে জিরো টলারেন্স নীতিতে আমরা রোধ করবো।