২০১৩ সালে বিজ্ঞানীরা স্পেনের সিমা ডে লস হিউএসস গুহায় এক অদ্ভুত জিনিস আবিস্কার করেন। তারা সেখানে মানুষের হাঁর খুজে পান। প্রথমত সবচেয়ে অস্বাভাবিক যেটা ছিল সেটা হচ্ছে এই হাঁরগুলোর লোকেশন। কারন গুহাটি ছিল ৪৩ ফিট গভীরে। মানুষের পক্ষে এরকম যায়গায় বসতি স্থাপন করা অসম্ভব। গুহাটিকে কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করার ও কোন নজির পাওয়া যায় নি। আরও গবেষণার পর এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম খুন।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার শুরুর দিকগুলোতে মানুষের স্বভাব নিয়ে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। একদিকে ছিল থমাস হবস – এর ধারনা, যিনি বলেছিলেন হোমোসেপিয়ান্সদের স্বভাব খুবই হিংসাত্মক এবং মানবজাতির যে এভোলিউশন তা যুদ্ধের ফসল। অন্যদিকে ছিলেন জ্য্যঁ জ্যাক রুশো। তিনি বিশ্বাস করতেন মানবজাতি বেড়ে উঠেছে একে অপরকে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। বর্তমান সময়ে এসেও এই বিতর্ক থেকেই গেছে।
স্প্যানিশ গুহায় পাওয়া হাড়ের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য বিজ্ঞানীরা হাড়গুলো খুব নিখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তারা গুহার একদম নিচের দিকে পরে থাকা ৫২ টি ভাঙ্গা টুকরো জোরা লাগিয়ে একটি মাথার খুলি তৈরি করেন। এরপর তার বয়স নির্ধারন করেন। দেখা যায় মাথার খুলিটি প্রায় ৪৩০,০০০ বছর আগের। কিন্তু এটি গবেষকদের জন্য আশ্চর্যের বিষয় ছিল না। বেশিরভাগ গবেষকদের ফোকাস ছিল খুলিটির বাম চোখের উপরের দুটি ভাঙা অংশের উপর। ভাঙা অংশ দুটির আকার একই রকম ছিল। প্রথমদিকে গবেষকরা ধারনা করেন খুলিতে আঘাতটি গুহার নিচে পরে যাওয়ার ফলে হয়েছে। কিন্তু গুহাটিতে এমন কিছুই ছিল না যা্র কারণে এরকম সিমেট্রিক্যাল ফ্র্যাকচার হতে পারে। ফ্র্যাকচারের আসে পাসে রিকভার করার কোন সাইন দেখা যায় নি। তার মানে হয় আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে অথবা মৃত্যুর পরে তার মাথায় আঘাতটি লাগে। বিজ্ঞানীরা খুলিটির ফ্র্যাকচারগুলো আরও নিখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন এবং সিদ্ধান্তে পোঁছান যে পাথরের বর্শা অথবা কুঠারের আঘাতে এই ক্ষত হয়েছে। তার মানে এটি একটি অভিপ্রেত খুন। ক্ষতটির লোকেশন দেখে বুঝা যায় খুনি নিহত ব্যাক্তিটির বাম চোখের উপর তার ডান হাত দিয়ে বেশ কয়েকবার আঘাত করে। এরপর খুনি মৃত ব্যাক্তিটির বডি টেনে নিয়ে এসে ডে লস হিউএসস গুহার নিচে ফেলে দেয়।
এটিই একমাত্র ব্যাক্তি না যার দেহাবশেষ গুহাটির নিচে পাওয়া গেছে, বিজ্ঞানীরা আরও ২৮ জনের মাথার খুলি ও হাড় আবিস্কার করেন সীমা ডে লস হিউএসস গুহায়। গবেষণা করে কারও শরীরেই কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে এই ব্যাক্তিদের গুহার নিচে ফেলে দেবার অনেক আগেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এমনটি হতে পারে যে বেশ কয়েকজন মিলে মানবজাতির ইতিহাসের প্রথম এই হত্যাকান্ড চালিয়েছিল। আবার এমনটিও হতে পারে যে এটিই ছিল ইতিহাসের প্রথম সিরিয়াল কিলিং।
এই ঘটনাটি ঘটেছে হোমো সেপিয়ান্সদের আসার ও ১৩০,০০০ বছর আগে। খুনি তার ভিক্টিমদের মতোই হোমো সেপিয়ান্সদের আগের প্রজাতি। এটা ধারনা করা যেতে পারে যে হোমো সেপিয়ান্সদের আগের প্রজাতিরা সহিংস ছিল এবং হোমো সেপিয়ান্সরা ছিল শান্তিপ্রিয়। কিন্তু সত্যটা ঠিক উলটো। হোমো সেপিয়ান্সরা পরবর্তিতে সহিংসতার আরও ভয়ানক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় রোমেনিয়ার সিয়োক্লোভিনা গুহায় মানুষের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হায় যার মধ্যে একটি মাথার খুলি ছিল যেটাতে কিছু অদ্ভুত আঘাতের চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। এই দেহাবশেষগুলো ছিল প্রায় ৩৩,০০০ বছর আগের। অনেক দিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এই খুলির আঘাতের কোন ব্যাখ্যা দিয়ে পারে নি। প্রায় ৭০ বছর পর বিজ্ঞানীরা আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এই অপরাধের রহস্যের কিনারা করে। বিজ্ঞানীরা আসল হাড়ের মতো পদার্থ দিয়ে কিছু ডেমো খুলি তৈরি করেন। তারপর তারা এই খুলিগুলোকে বিভিন্ন উচ্চতা থেকে ফেলে এবং বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পরিক্ষা করেন। খুলিগুলোকে দুটি পোজিশনে রেখে পরিক্ষা করা হায়। প্রথমে শুয়িয়ে রেখে ও পরে খাড়া করে রেখে। এতে করে ভিক্টিমদের শোয়া অবস্থায় নাকি দাঁড়ানো অবস্থায় মারা হয়েছে তা বের করা সহজ হবে। বেশ কয়েকবার আঘাত করার পর বিজ্ঞানীরা সে ডাটা নিয়ে আসল খুলির সিটি স্ক্যানের ডাটার সাথে মিলিয়ে দেখেন। আসল খুলিতে আঘাত রিকভার করার কোন চিহ্ন ছিল না। খুলির ফ্র্যাকচার দেখে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে আসেন আঘাতের সময় খুলির নিচে ব্রেইন টিস্যু ছিল, সুতরাং আঘাতের কারনেই মৃত্যু হয়েছে এমনটিই ধারনা করা হয় । বিজ্ঞানীদের মতে আঘাতের সাথে সাথেই ভিক্টিম মারা যায় নি। প্রথম আঘাতের পর ভিক্টিম মুখ থুবরয়ে পরে যায়। তারপর সে উঠে দাঁড়ালে খুনি তার বাঁ হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে আবারও আঘাত করে। এতে ভিক্টিমের খুলির পিছন দিকটা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এটা হোমো সেপিয়ান্সদের মধ্যে ঘটা প্রথম হত্যাকান্ড।
আজকের দিনে আমরা আমাদের হিংস্রতার জন্য মিডিয়াকে দায়ী করি। আমরা দায়ী করি ফিল্ম, ভিডিও গেম, সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন ইত্যাদিকে। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসের প্রথম খুনির কাছে এসব কিছুই ছিল না যা তাকে এরকম হিংস্র কাজে উৎসাহিত করবে। বায়োলজিস্টদের মতে হিংস্রতা মানুষের মাঝে ন্যাচারাল ভাবেই আসছে। আমাদের পর্বপুরুষরা সবসময়ই যুদ্ধে রত থাকতো টিকে থাকার জন্য। যারা সবচেয়ে হিংস্র তারাই টিকে থাকতে পেরেছে। মানবজাতির এভোলিউশনে এই জেনেটিক ইনফরমেশন জেনেরেশন থেকে জেনেরেশনে পাস হতে থাকে। এবং আমরা তাদেরই বংশধর।