ডেস্ক নিউজ
মালদ্বীপের কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশী বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে ‘বন্দী বিনিময় চুক্তি’ হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে উভয়পক্ষ কয়েকবার খসড়া চুক্তির বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব বিনিময় করে এবং বাংলাদেশ-মালদ্বীপ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে প্রস্তাবিত চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিষয়ে উভয়পক্ষ নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। আগামী ২২-২৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরকালে চুক্তিটি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি রয়েছে। বন্দী বিনিময় চুক্তি ছাড়াও কয়েকটি চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর করার কথা।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আব্দুল মোমেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপ সফরকালে বন্দী বিনিময় চুক্তিসহ বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করার কথা রয়েছে। যেসব বিষয় নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে তা পরে জানিয়ে দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল থেকে বন্দীদের স্থানান্তরের বিষয়ে বাংলাদেশ এবং মালদ্বীপ সরকারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরপর উভয়পক্ষ কয়েকবার খসড়া চুক্তির বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব বিনিময় করে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন মালদ্বীপ সফরকালে চুক্তিটি স্বাক্ষরের জন্য চূড়ান্ত খসড়া বাংলাদেশ সরকারের মতামতের জন্য প্রেরণ করে। মালদ্বীপ থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবিত চুক্তিটি পুনর্গঠন করে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগ, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভেটিং গ্রহণ করা হয়েছে। লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগ প্রয়োজনীয় সংশোধনপূর্বক খসড়া চুক্তির বিষয়ে ভেটিং প্রদান করে। ওই চূড়ান্ত খসড়া চুক্তিটি স্বাক্ষরে মালদ্বীপ সরকার সম্মত হয়েছে। গত ২৭ নবেম্বর মালেতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-মালদ্বীপ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে প্রস্তাবিত চুক্তিটি স্বাক্ষরের বিষয়ে উভয়পক্ষ নীতিগতভাবে একমতও হয়েছে। আগামী ২২-২৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মালদ্বীপ সফরে চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরের কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ-মালদ্বীপ সুদীর্ঘ সম্পর্কের ইতিহাস। তবে বন্দী বিনিময় চুক্তির ফলে এ সমস্যার সমাধান ও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলে উভয় দেশই আশা প্রকাশ করেছে। দুই দেশের মধ্যে এর আগেও বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে মালদ্বীপে অবস্থানরত অবৈধ বাংলাদেশী শ্রমিকদের বৈধ করা, দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া, নতুন কর্মী পাঠানো এবং দুই দেশের ফরেন সার্ভিসের উন্নয়নে দু’টি চুক্তি সই হয়েছে। মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লা শহিদের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ফরেন সার্ভিস একাডেমির সঙ্গে এই চুক্তি সই হয়। তখন বাংলাদেশ থেকে মালদ্বীপে মানবসম্পদ পাঠানো এবং বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সহযোগিতার বিষয়ে দু’টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এরপর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দুই সমঝোতা চুক্তি সইসহ বৈঠকের নানাদিক তুলে ধরেন মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।
মালদ্বীপের মন্ত্রী আবদুল্লা শহিদ বলেছিলেন, একটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে দুই দেশের মধ্যে জনবল আদান-প্রদানে এবং বাংলাদেশ থেকে জনবল নিয়োগে শক্ত কাঠামো ঠিক করতে। বাংলাদেশী কর্মীদের মালদ্বীপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং মৌলিক অধিকার ও জীবনমান রক্ষায় অবৈধকর্মীদের বৈধ করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।
এরপর মার্চে বাংলাদেশে আসেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহর। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহর বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে চারটি সমঝোতা স্মারকে সই হয়। সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে ছিল যৌথ কমিশন গঠন (জেসিসি), পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক, সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে সহায়তা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়।
সবশেষ নবেম্বরে বাংলাদেশে তিন দিনের সরকারী সফরে আসেন মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিম। ফয়সাল নাসিমের বাংলাদেশ সফরে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যু ছাড়াও জনশক্তি রফতানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়েও আলোচনা হয়। মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্টে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশ মানবসেবা ও স্বাস্থ্যসেবায় মালদ্বীপকে কারিগরি সহায়তা দিতে পারে। আমরা আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অভিজ্ঞতা মালদ্বীপের সঙ্গে বিনিময় করতে পারি। এ সময় মালদ্বীপকে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সেবা ব্যবহার করার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
তবে মালদ্বীপ কোন সঙ্কটের সম্মুখীন হলে বাংলাদেশের সমর্থন পায় বলে জানিয়েছিলেন মালদ্বীপের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল নাসিম।
মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন ও গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকার, জয়েন্ট কমিশন অন টেকনিক্যাল এ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন, দ্বৈত কর প্রত্যাহার, বন্দী বিনিময় চুক্তিসহ কিছু সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত করাসহ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্র নিয়ে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকালে আলোচনা হয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে দু’দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত ও আলোচ্য বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।
বর্তমানে শুধু ভারত ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তি রয়েছে। প্রস্তাবিত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে এবং মালদ্বীপের কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশী বন্দীদের সহজে ফেরত আনতে পারবে বাংলাদেশ। তেমনি বাংলাদেশের কারাগারে আটক মালদ্বীপের বন্দীদের সহজে ফেরত নিতে পারবে মালদ্বীপ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, মালদ্বীপের বিভিন্ন কারাগারে বর্তমানে ৪৩ সাজাপ্রাপ্ত এবং ৪০ বিচারাধীনসহ মোট ৮৩ বাংলাদেশী বন্দী রয়েছে। তবে বাংলাদেশের কারাগারে মালদ্বীপের কোন নাগরিক আটক নেই।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এরপর থেকে দুই দেশ বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপে প্রায় এক লাখ প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন, যা দেশটিতে কর্মরত মোট প্রবাসী কর্মীর ৭০ শতাংশ। প্রবাসী বাংলাদেশীরা সেখানে নির্মাণ, পর্যটন, বিপণন, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য খাতসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই কাজ করেন। সম্প্রতি মালদ্বীপে বেশকিছু প্রবাসী বাংলাদেশী আনডকুমেন্টেড হয়ে পড়েছেন, যার মধ্যে অনেকে ২০১৯ সালে মালদ্বীপ সরকারের গৃহীত নিয়মিতকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার সুযোগ নেন।
শ্রম বাজারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের চুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি খুব কম দেশের সঙ্গেই রয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের চার দেশে তথা সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান ও কাতারের সঙ্গে প্রায় ৯ বছর আগে বন্দী বিনিময় চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেটি এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে পর্যায়ক্রমে এসব দেশের সঙ্গেও বন্দী বিনিময় চুক্তি করা হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
২০১৩ সালের ২৩ অক্টোবর অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে কার্যকর হয় ভারত ও বাংলাদেশের বহিঃসমর্পণ চুক্তি। আর থাইল্যান্ডের সঙ্গে এ চুক্তি আরও আগ থেকে রয়েছে। যার আওতায় দুই দেশ ফৌজদারি মামলায় বিচারাধীন বা দ-প্রাপ্ত আসামি বিনিময় করতে পারবে। বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় ভারতের কারাগারে প্রথম বন্দী হিসেবে বাদল ফারাজিকে বাংলাদেশ ফেরত এনেছে। থাইল্যান্ড থেকেও এ চুক্তির আওতায় বন্দীদের ফেরত এনেছে বাংলাদেশ। নতুন করে মালদ্বীপ থেকে এ চুক্তির আওতায় বন্দীদের ফেরত আনার সুযোগ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের।