ডেস্ক নিউজ
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বুকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশে চালানো হয় নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ। গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য ও প্রধান টার্গেট ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় আয়োজিত সমাবেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এসে সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই ঘটনায় শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের আঘাতে আইভি রহমানসহ মোট ২৩ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারান।
২১শে আগস্ট উপলক্ষে ২৪ আগস্ট, ২০২০ রাত ৮ টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজন করেছে বিশেষ ভার্চুয়াল ওয়েবিনার ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও রাষ্ট্রীয় মদদে জঙ্গিবাদের উত্থান’ বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচারিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে।
ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তবে দেখা যায় তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে, তাদের ছত্রছায়ায় এই ঘটনাটি সংগঠিত হয়েছে। আমাদের মুক্তাঙ্গনে সমাবেশের কথা থাকলেও পুলিশের বাঁধার মুখে সরে গিয়ে অস্থায়ী মঞ্চ করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে বাধ্য হই। মুক্তাঙ্গনে এমন হামলা করা সম্ভব নয় বলে আমাদের সরিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে নিয়ে আসা হয় যাতে ওদের প্লান সাকসেস করতে পারে।
গ্রেনেড হামলার পর পরই টিয়ার গ্যাস ও গুলি করে নেতা-কর্মীদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং যারা হামলার সাথে জড়িত তারা যাতে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারে সে ব্যবস্থা করতেই পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে। এরপর ফায়ার ব্রিগেড ডেকে পানি দিয়ে পুরো এলাকা ধুয়ে আলামত নষ্ট করে ফেলে। আমাদের আহত নেতা-কর্মীদের সাহায্য সহযোগিতা না করে প্রশাসন উলটো আমাদের উপর হামলা করলো। নামে মাত্র একটা তদন্ত কমিটি গঠন, জর্জ মিয়া নাটক সাজানো, এমনকি সংসদ চলাকালীন সময়ে এমন ঘটনা ঘটলেও সংসদে এই ব্যাপারে আলোচনা করারও সুযোগ দেয়া হয়নি। কেন এমনটা করেছিলো তৎকালীন জোট সরকার প্রশ্ন করেন এই বর্ষীয়ান নেতা।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার শুরুটা ১৫ আগস্ট থেকে শুরু করে একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা। বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যা, জাতীয় ৪ নেতাদের হত্যা, বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবেশ, একটি নব্য পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুটা হয়েছিলো ১৫ আগস্ট, তারই ধারাবাহিকতায় ১৫ আগস্টে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালায় সেই পুরানো একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা। যখনই শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেছিলো ততবার একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা বারবার হামলা চালিয়েছে শেখ হাসিনার উপর। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, এটা ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতারই একটি অংশ।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, সেদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার, ক্ষমতার আর এক কেন্দ্র বিন্দু ছিলো হাওয়া ভবন- যা পরিচালনা করতো খালেদা জিয়ার কু-পুত্র তারেক রহমান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যে গ্রেনেড হামলা হইছে তা একবারে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়নি, এটি ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার, সেদিন আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর জীবন নাশের উদ্দেশ্যে বাড়িঘরে আগুন দেয়, ধর্ষণ করে, চিরদিনের জন্য আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংককে ধ্বংস করাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তথা জঙ্গিবাদ।
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন ধংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে দেশ নির্মাণের দিকে মনোযোগ দিলেন ঠিক তখনই একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা ষড়যন্ত্র শুরু করলো। এই শক্তি কখনও বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেনি। তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বারবার ষড়যন্ত্র করে গেছে। সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে যারই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে ১৫ আগস্ট ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলো ৭১ এর পরাজিত শক্তি তথা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস লালনের শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়, জিয়া ক্ষমতায় এসে ১৯৭৯ সালে পার্লামেন্টে সেটাকে আইনে রূপান্তর করে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শুরুটা জিয়া পরিবারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান, যার প্রমাণ ১৯৯১-১৯৯৬ পর্যন্ত তার স্ত্রী বেগম জিয়ার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং ২০০১-২০০৬ ক্ষমতায় থাকাকালীন তার কু-পুত্র তারেক রহমানের জঙ্গিদের লাললনপালন ও আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।
তিনি আরো বলেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা যে রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার অনুমোদনে এবং তারেক রহমানের পরিচালনায় যে গ্রেনেড হামলা হয়েছে এটা আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট। বেগম খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় তখন জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের উত্থান হয়েছে, বাংলা ভাইয়ের উত্থান হয়েছে, ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা হয়েছে, ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যার উদ্দেশে গ্রেনেড হামলাও এই খালেদা জিয়ার আমলেই হয়েছে। সব দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যখনই জিয়া পরিবার ক্ষমতায় এসেছে তখনই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস লালন পালন হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলো, স্বাধীনতাকে হত্যা করেছিলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করেছিলো। ওরা মনে করেছিলো, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হত্যা করবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করবে, গণতন্ত্রকে হত্যা করবে। কিন্ত আল্লাহ্’র রহমতে জননেত্রী শেখ হাসিনা আজকে বেঁচে আছেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘সেদিন খালেদা জিয়া এই ঘটনা থেকে যখন বিরোধী দলীয় নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারেন নাই, আল্লাহ্ যখন তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তখন তারা আসলে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার নেপথ্য হলো জনগণ দিয়ে ক্ষমতাই থাকার তাদের কোনো সুযোগ নেই, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এবং দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই ধরনের জঙ্গিবাদ উত্থানের মধ্য দিয়ে তারা শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা চালিয়েছেন।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম বলেন, ‘১৫ই আগস্ট ও ২১শে আগস্ট একই সূত্রে গাঁথা। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা সম্বন্ধে বলা যাবে না। তারা মনে করেছিলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই এদেশে আর কোনো মানুষ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবে না, কিন্তু তাদের সেই আশা পূরণ হয় নাই। যখন তারা দেখলো তাদের এই আশা পূরণ হবে না, তখন তারা বঙ্গবন্ধুর সীপাহশালার ৪ জনকে জেলখানায় হত্যা করে। তাদের হত্যা করার একটাই কারণ ছিলো যে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তারা স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন এরা যদি বেঁচে থাকে হয়তো বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা আবার গর্জে উঠবে। তারপরে এখানেও যখন তারা সফল হলো না তখন তারা বেছে নিলো বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার গায়ে প্রবাহিত তাদের যদি শেষ করতে না পারি তাহলে তাদের ইচ্ছা পূরণ হবে না। এজন্যই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে মোট ১৯ বার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।’
২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাক্ষী মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.) বলেন, ২১শে আগস্টে রাতে ঘটনাস্থলে যে গ্রেনেড দুটি পেয়েছি হুবহু সেইম গ্রেনেড পরের দিন গোলাপ শাহ মাজারের পাশে এবং জেলখানার পাশে আর একটি গ্রেনেড আমি পেয়েছিলাম। ২১ আগস্ট পাওয়া গ্রেনেড দুটি ধ্বংস করে দেয়ার নির্দেশ ছিলো আমার কাছে, কিন্তু আমি গ্রেনেডগুলো আমাদের ব্রিগেডে নিয়ে আসি। অনেক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আসে গ্রেনেডগুলো নেড়েচেড়ে দেখে তারাও রায় দেয় যে, এগুলো যুদ্ধে ব্যবহার করে এমন গ্রেনেড। সেদিন বিকেলে সেনাবাহিনীর বড় কর্মকর্তা এসে গ্রেনেড দুটো নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
তিনি আরো বলেন, আমার বাড়িতে প্রশাসনের লোকজন গেলো, আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আমাকে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্য করে অবসর নিতে। ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় আমি আমার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে একজন সাক্ষী হিসেবে রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ালাম।
আলোচনায় অংশ নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন বলেন, ‘এরকম ন্যক্কারজনক ঘটনা যেটা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আরে নেই। একটা রাজনৈতিক দলকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ১৫ই আগস্টের যেই অসমাপ্ত কাজ রাষ্ট্রীয় মদদে ২১শে আগস্টে করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মদদে এবং রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় এবং প্রত্যক্ষ মদদে ওই সময় জঙ্গিদেরকে লালন পালন করা হয়েছে বাংলাদেশকে জঙ্গিদের চারণভূমি করার জন্য এবং সেই প্রচেষ্টা এখন অনেকটাই ব্যর্থ।’
আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল ছাড়াও অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচারিত হয় বিজয় টিভির পর্দায়, সময় টিভি, বিডি নিউজ২৪, বাংলা নিউজ২৪, বার্তা২৪, সমকাল, যুগান্তর, ইত্তেফাক, সারাবাংলা, ভোরের কাগজ, ঢাকা টাইমস২৪, জাগো নিউজ২৪ ও বাংলাদেশ জার্নালের ফেসবুক পাতায়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায়।