ডেস্ক নিউজ
- পোশাকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জিএসপি সুবিধা পেতে তোড়জোড়
- আগামী মাসে ইউএসটিআরকে চিঠি দেয়া হবে
- আলোচনা ও দরকষাকষির প্রস্তুতি
- সহজ হবে এলডিসি থেকে উত্তরণ ও করোনা সঙ্কট মোকাবেলা
এম শাহজাহান ॥ পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) আদায়ের তোড়জোড় শুরু করেছে বাংলাদেশ। এজন্য খুব শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হবে। দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই চিঠি পাবে যুুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতর ইউএসটিআর (ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেনটিটিভ)। দেশটির নতুন প্রশাসনের সঙ্গে শুধু জিএসপি ইস্যুতে আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে রফতানি আয়ে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। গতি সঞ্চার হবে এলডিসি উত্তরণ এবং করোনা সঙ্কটের মুখে পরা দেশের অর্থনীতি। বাড়বে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে যখন দায়িত্ব নেন সেই সময় জিএসপি পাওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ট্রাম্প প্রশাসন তাতে সাড়া না দিয়ে বরং কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি ও শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেয়। এরপর আর জিএসপি ইস্যুতে কখনও আলোচনা হয়নি। এর আগে ২০১২ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের সকল পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। পোশাক খাত উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসটিআরের এ্যাকশন প্লান ১৭টি শর্ত আরোপ করে। যদিও পোশাক রফতানিতে ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধার বাইরে রাখা হয়। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর আন্তর্জাতিক বাজারে চরম ভাবমূর্তি সঙ্কটেও পড়ে বাংলাদেশ।
গত বছরের শেষ নাগাদ ইউএসটিআরের এ্যাকশন প্লানের ১৭ শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ও শ্রম অধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এখন আর তেমন কোন অভিযোগ নেই। এলডিসি দেশ হিসেবে রফতানিতে জিএসপি সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের অধিকার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুসরণ না করে বাংলাদেশকে এই সুবিধার বাইরে রাখা হয়েছে। শ্রম অধিকার ইস্যুতে ভিয়েতনামের অবস্থান বাংলাদেশের নিচে হলেও সেখানকার উদ্যোক্তারা পোশাক রফতানিতে জিএসপি সুবিধা পান। একইভাবে চীন, ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জিএসপি সুবিধায় পণ্য রফতানি করছে। শুধু বাংলাদেশকে বড় অঙ্কের শুল্ক দিয়ে পোশাক রফতানি করতে হয়। আগামী ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ কারণে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। অর্থনীতির কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে দ্রুত গতিশীল করতে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা নিশ্চিত করা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের কাছে পোশাক রফতানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য বা জিএসপি সুবিধা চাওয়া হবে। করোনা সঙ্কট ও এলডিসি উত্তরণে এই সুবিধায় প্রবেশ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। একক দেশ হিসেবে দেশটিতে সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ। অথচ শ্রম ইস্যুসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে জিএসপি সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, জিএসপি সুবিধা পাওয়া এবং এর পেছনে যেসব যুক্তি রয়েছে তা উল্লেখ করে একটি চিঠি ড্রাফট করে রেখেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেয়ার পরই তা ইউএসটিআরে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আশা করছি, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে এই সুবিধা দেয়া হবে। ইউএসটিআরের এ্যাকশন প্ল্যানের বেশির ভাগ শর্ত ভালভাবে পূরণ করেছে বাংলাদেশ। শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন সব আন্তর্জাতিক সংস্থা দেশের গার্মেন্টস খাত নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার যৌক্তিক কারণগুলো বাইডেন প্রশাসনের কাছে উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ। এতে দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা অর্থনৈতিক সঙ্কটগুলো একে একে দূর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা। পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। দেশটিতে রফতানির ৯৮ শতাংশ হচ্ছে পোশাক সামগ্রী। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৮ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় ৫১ হাজার কোটি এবং বিপরীতে আমদানি হয় ১৭ হাজার কোটি টাকার পণ্য। শুধু পোশাক রফতানির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রকে বছরে শুল্ককর দিতে হচ্ছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য প্রতিবছর বাড়ছে।
একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে কোন শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যায় না। যদিও পোশাকের বাইরে অপ্রচলিত ৯৭ ভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে আবার শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে রাখা হয়েছে যা, রফতানির ক্ষেত্রে কোন কাজে আসছে না। এ নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে দরকষাকষি চলছে গত ১৬ বছর ধরে। সংস্থাটির দোহা রাউন্ডে বিষয়টি মীমাংসার কথা বলা হলেও তার কোন সুরাহা হয়নি। অন্যদিকে পোশাক-রফতানির ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া হয়েছে। ফলে বরাবরই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। সমস্যাটি সমাধানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশনা থাকলেও তৎকালীন ওবামা প্রশাসন এ বিষয়ে এগিয়ে আসেনি। বিদায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনও সেই ধারা বজায় রাখে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ৪ হাজার ৮৮০টি পণ্যে ১২৯টি দেশকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দিয়েছে। এ দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ৫০ রফতানিকারক দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। এছাড়া রফতানিতে বাংলাদেশের ৯৭টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্টস, টেক্সটাইল এবং নিটওয়্যার পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়া হয়নি। ফলে ৯৭টি পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দেয়া হলেও তার অধিকাংশ পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় না। অথচ গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও নিটওয়্যার এই তিনটি পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া গেলে দেশের রফতানি আয় আরও বাড়ানো যেত। স্বল্পোন্নত বা এলডিসি দেশ হিসেবে রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার। বিষয়টি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় দরকষাকষির বাইরেও সরকার বিভিন্ন ফোরামে বলে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে কথা বলার এখন সবচেয়ে শক্তিশালী ফোরাম হচ্ছে টিকফা। ইতোমধ্যে এ ফোরামের ৫টি বৈঠক করেছে উভয় দেশ। টিকফা ফোরামের সব বৈঠকেই শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার ওপর জোর দিয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র ও এলডিসি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সব ধরনের শুল্ক কর সুবিধা পাওয়ার কথা। ২০১২ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর রফতানিতে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার ওপর স্থগিতাদেশ দেয় মার্কিন সরকার। এর আগে ২০০৫ সালে কোটামুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিআইয়ের সাবেক উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমেরিকার কাছ থেকে শুল্ক ও কোটা সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকে দরকষাকষির দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে এখনও দুর্বল অবস্থানে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, একতরফাভাবে বাংলাদেশকে কিছু দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাধ্যমে দরকষাকষি করে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধার দাবি আদায় করতে হবে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, জিএসপির আওতায় বাংলাদেশর মোট রফতানির মাত্র ৩ শতাংশ যায় আমেরিকায়। এছাড়া বাংলাদেশের প্রধান রফতানিযোগ্য পণ্য পোশাক ও টেক্সটাইল জিএসপির তালিকায় নেই। ফলে নতুন সরকারের কাছে বাংলাদেশের একমাত্র দাবি পোশাক পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা আদায়। পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি হয়। অথচ সেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায় না। আশা করছি, নতুন জো বাইডেন সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হবে। ব্যবসায়ীদের কোন সহযোগিতা প্রয়োজন হলে তা করা হবে।