রাজশাহীতে হু হু করে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। সংক্রমণের দিক থেকে এরই মধ্যে রাজশাহীকে ঝুঁকিপূর্ণ (উচ্চ সংক্রমণে) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এবার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারও বেশি। যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন- তাদের অধিকাংশেরই অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হচ্ছে।
তবে করোনা রোগী পাল্লা দিয়ে বাড়লেও ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) একটিও বেড বাড়েনি! ফলে বর্তমানে আইসিইউ বেডের জন্য চারিদিকে হাহাকার পড়ে গেছে।
অথচ রাজশাহীসহ এ বিভাগের আট জেলার জন্য আইসিইউ বেড রয়েছে মাত্র ৫৫টি।
এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ৪৫টি এবং বেসরকারি ১০টি।
এগুলোয় করোনা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটর সুবিধা রয়েছে।
আর বিভাগের এ ৪৫টি আইসিইউ বেডের মধ্যে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে রয়েছে ২০টি। এর মধ্যে প্রায় সবগুলোই করোনা রোগীর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আর মাত্র ১/২টি বেডে হৃদরোগসহ অন্যান্য মুমূর্ষু রোগীর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে বর্তমানে কোনো বেডই ফাঁকা নেই। এছাড়া বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে ১৩টি এবং বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ৮টি আর সিরাজগঞ্জের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে রয়েছে ৪টি আইসিইউ বেড।
এদিকে, গতবার রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় ১ হাজার ৬২০টি আইসোলেশন বেড থাকলেও এবার নেই। তাই স্বল্প সংখ্যক জনবল ও আইসিইউ বেড নিয়ে করোনা চিকিৎসা দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক ও নার্সদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিদিন অনেকের একান্ত প্রয়োজন থাকলেও আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে, রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দফতর থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী-বিভাগের আট জেলায় রোববার (৪ এপ্রিল) পর্যন্ত মোট করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৭ হাজার ২১৪ জন। এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪১৩ জনের। বর্তমানে করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৩ হাজর ১২৭ জন। এছাড়া চিকিৎসা নিয়ে করোনা মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ২৪ হাজার ৮৪৮ জন রোগী।
রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ‘রাজশাহী সিটি করপোরেশনসহ জেলায় এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৩৩ জনে। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৪৪০ জন। মৃত্যু হয়েছে ৫৬ জনের। বর্তমানে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০টি আইসিইউ বেড রয়েছে। এগুলো দিয়েই করোনা সঙ্কট মোকাবিলা করা হচ্ছে। এবার জেলায় কোনো আইসোলেশন সেন্টার খোলা হয়নি।
কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। দেশের ৩১টি জেলা করোনা ভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকিতে। এর মধ্যে রাজশাহী জেলা এখন ১৭ নম্বরে উঠে এসেছে বলে জানান রাজশাহী সিভিল সার্জন।
এক সপ্তাহ সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁঁকিতে থাকা জেলাগুলোর মধ্যে রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী জেলা, বগুড়া, নওগাঁ ও নাটোর জেলা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁঁকিতে রয়েছে রাজশাহী ও বগুড়া জেলা। বিভাগের এ দুই জেলায় বিভিন্ন কল-কারখানা ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বেশি। এজন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে। এছাড়া ভারতে বিভিন্নকাজে এ দুই জেলার মানুষই বেশি যাচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মানতে অসচেতন থাকায় করোনা সংক্রামণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস জানান, তিনতলা বিশিষ্ট ৫৩০ শয্যার হাসপাতাল ভবনটি ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে চালু হয়। মূল ভবনের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাতে আরও একটি নতুন চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যা ২০১২ সালে চালু করা হয়। এতে আরও ৩৫২ বেড ও ৬টি অপারেশন থিয়েটার যুক্ত করা হয়। ফলে হাসপাতালের মোট বেড সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৬২। হাসপাতলে অপারেশন থিয়েটারের উত্তর পাশে আরও একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। তাতে ১০ বেড বিশিষ্ট আইসিইউ চালু করা হয় ২০১২ সালে। বর্তমানে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ১ হাজার ২০০টি।
করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ দ্বিগুণ করা হয়েছে। এছাড়া নতুন করে ২৫ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। চিকিৎসকরা আক্রান্ত হলে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে রাখা হচ্ছে আর নার্সরা আক্রান্ত হলে ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে। তাদের মোটামুটি সব সরঞ্জম রয়েছে। চিকিৎসক ও নার্সদের আবারও নতুন করে রোস্টার করা হয়েছে।
কিন্তু এর পরও প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয় বারের করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ বেশি। কারণ করোনার প্রথম ওয়েভে রামেক হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ শতাধিক। কিন্তু এখন রোগী থাকছে গড়ে ২ থেকে আড়াই হাজার পর্যন্ত। করোনা ও অন্য সব বিভাগের রোগীদের একসঙ্গে সেবা দিতে হচ্ছে। তাই এটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। আইসিইউ-কেবিন, কোথাও জায়গা নেই।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাবিবুল আহসান জানান, রাজশাহী বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শনাক্তের সংখ্যা বগুড়া ও রাজশাহীতে। গত মাসেও করোনা টেস্ট ও শনাক্তের সংখ্যা কম ছিল।
কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে রোগীর সংখ্যাও ততই বাড়ছে। প্রতিদিন প্রায় ৮০০ জনের মতো করোনা টেস্ট করছেন। এর মধ্যে শতাধিক ব্যক্তি শনাক্তও হচ্ছেন।
আর সর্বোচ্চ ২০টি আইসিইউ বেড নিয়ে চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই সব কার্যক্রম চলছে। এছাড়া সবমিলিয়ে রাজশাহী বিভাগে ৫৫টি আইসিইউ বেড রয়েছে। তার মধ্যে ১০টি বেসরকারি ক্লিনিকে এবং ৪৫টি সরকারি হাসপাতালে। তবে আইসিইউ বেডের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না করতে পারলেও আমরা জেনারেল বেডে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করছি। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। কারণ জেনারেল বেডে অক্সিজেনের সাপোর্ট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে আর কোনো রোগীকে আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। দ্রুতই এ নতুন ব্যবস্থাপনা চালু করা হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক।